নগদ বনাম বিকাশ: আর্ট অব ওয়ার
চলুন একটা গেম খেলি। কল্পনা করুন বিকাশ এবং নগদ-কে মার্ভেল/ডিসি কমিকসের মত কোন কমিকস এর সুপারহিরো হিসাবে, আপনার কল্পনায় এরা দেখতে কে কেমন হবে? যদি এদের মধ্যে একটা চরম লেভেলের যুদ্ধ হয়, তবে কে জিতবে?
আসুন একটু বোঝার চেষ্টা করি বাংলাদেশের MFS দুনিয়ায় সফল এই দুই ব্র্যান্ডের মার্কেটিং কলাকৌশল, এবং প্রেডিক্ট করার চেষ্টা করি এখন পর্যন্ত এগিয়ে কে আছে? লেখাটি অনেক বড় হয়ে যাওয়ায় আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
মার্কেটিংয়ের ছেলে-বুড়ো সবার কাছে ফিলিপ কটলার নামটি অতিপরিচিত। তাঁর লিখা 'প্রিন্সিপলস অফ মার্কেটিং'-কে ধরা হয় মার্কেটিং এর বাইবেল। সম্প্রতি একটি নিউজে দেখলাম বিখ্যাত এ বইটির লোকাল ভার্সনে 'বিকাশ' এর দু'টি রিয়েল লাইফ কেইস স্টাডি যুক্ত করা হয়েছে। খবরটি আমার জন্য বেশ সুখকর ছিল, কারণ আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আলমগীর স্যারের হালাল মার্কেটিং এর কেইস স্টাডি ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো কেস স্টাডি একাডেমিক বইগুলোতে ছিলনা।
যাহোক, ছাত্রজীবনে বেশ কিছু বিজনেস/মার্কেটিং কেইস কম্পিটিশনে পার্টিসিপেশন করার সুবাদে আমার একাডেমিক বইয়ের বাইরেও বেশ কিছু মার্কেটিং, ব্র্যান্ডিং রিলেটেড বই-পত্র পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, তন্মধ্যে আল রাইস ও জ্যাক ট্রাউট এর লিখা 'মার্কেটিং ওয়ারফেয়ার' বইটি অন্যতম। এ বইটি পড়ে আমি মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এক ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পাই। বইটি লেখা হয়েছে চৈনিক জেনারেল সুন জু এর 'দ্যা আর্ট অব ওয়ার' বইটির সূত্র ধরে। এই বইটিতে বলা হয়েছে মার্কেটিংয়ের দুনিয়া আর যুদ্ধ ক্ষেত্র একই। যুদ্ধে জেতার কলা-কৌশলকে মার্কেটিং ওয়ারফেয়ার-এ কনভার্ট করে বইয়ে চারটি মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি উল্লেখ করা হয়েছে,
১. ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি
২. অফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি
৩. ফ্ল্যাংকিং স্ট্র্যাটেজি
৪. গেরিলা স্ট্র্যাটেজি
বিকাশ এবং নগদ-এর মার্কেটিং ওয়ারফেয়ার এ জয়ী কে হতে পারে, এই প্রেডিকশন করার জন্য আমি প্যারামিটার ধরেছি আল রাইস ও জ্যাক ট্রাউট লিখিত 'মার্কেটিং ওয়ারফেয়ার' বইয়ের স্ট্র্যাটেজি গুলোকে। নগদ বা বিকাশ যে-ই স্ট্র্যাটেজি গুলো বেশিরভাগ সময় ফলো করেছে আমি তাকেই সেই পয়েন্ট বা প্যারামিটারে এগিয়ে রেখেছি।
লেটস ডাইভ ডিপ ইন টু দিস
বিকাশ: 'দ্যা ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস' পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় ৪০% মার্কেট শেয়ার নিয়ে বাংলাদেশের MFS ইন্ডাস্ট্রির একচ্ছত্র মার্কেট লিডার বিকাশ। 'মার্কেটিং ওয়ারফেয়ার' বইটির সূত্র মোতাবেক যেই ব্র্যান্ড মার্কেট লিডার তাকে খেলতে হবে ডিফেন্সিভ ওয়ারফেয়ার স্ট্র্যাটেজিতে। তো আমরা ধরে নিচ্ছি, বিকাশ একটি ব্র্যান্ড হিসেবে এই ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজিতেই এগুচ্ছে। এখন ব্রেকডাউন করা যাক এই স্ট্র্যাটেজির তিনটি কোর কৌশলকে।
১. "শুধুমাত্র যেই ব্র্যান্ড মার্কেট লিডার কেবলমাত্র সে-ই ডিফেন্সিভ ওয়ারফেয়ার স্ট্র্যাটেজি এ্যাপ্লাই করতে পারবে।"
বিকাশ শুধু মার্কেট শেয়ার নয় ভিজিবিলিটি, কাস্টমারের মস্তিষ্কসহ সকল ক্ষেত্রেই এখনো ক্লিয়ারলি এক নাম্বারে আছে বলেই আমার ধারণা। তাই, একমাত্র এই ইন্ডাস্ট্রিতে কোন ব্র্যান্ড যদি ডিফেন্সিভ ওয়ারফেয়ার প্লে করতে চায় তা নি:সন্দেহে বিকাশ।
এই পয়েন্ট তাই খুব ক্লিয়ারলি-ই বিকাশের পক্ষে।
২. "বেস্ট ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি হলো নিজেই নিজেকে আক্রমণ করা।"
অর্থাৎ, কমপিটিটর আপনাকে নতুন প্রডাক্ট, প্রাইস, প্লেস বা প্রোমশন দিয়ে এট্যাক করার আগেই প্রোএক্টিভলি নিজেই একাজ গুলো করা, ইনোভেশন নিয়ে আসা।
এই পয়েন্টে, বিকাশ কিছু কাজ ঠিক মতো করেছে তবে সব কাজ নয়। উদাহরণ স্বরুপ, বিকাশ অ্যাপ লঞ্চ করেছে, বিলস পে করার অপশনস এনেছে তবে কাস্টমারের আসল পেইন পয়েন্টে প্রো-এক্টিভলি তেমন কিছু করতে পারেনি। ক্যাশ আউট চার্জ কিংবা সেন্ড মানিতে চার্জ কাটা এগুলোতে বিকাশ হালকা-পাতলা যে-ই ইনিশিয়েটিভ নিয়েছে তার সবই রিএক্টিভ এপ্রোচ।
ওভারঅল, এই পয়েন্ট আমার হিসেবে তাই বিকাশের বিপক্ষে।
৩. "কমপিটিটরের যেকোন স্ট্রং মুভ ব্লক করা।"
বিকাশ এই ক্ষেত্রেও আমার কাছে মনে হয় ব্যর্থই হয়েছে। ক্যাশআউট চার্জ নগদ যখন এক ধাক্কায় অনেক খানি কমিয়ে ফেলল বা সেন্ড মানি ফ্রি করে দিলো তখনো বিকাশ কি সব ৫ টি প্রিয় নম্বর, প্রিয় এজেন্ট হাবিজাবি ক্যাম্পেইন নিয়ে আসলো, সাধারণ কাস্টমার হয়ে পড়ল আরো বিভ্রান্ত। সবথেকে রিসেন্ট উদাহরণ নগদ বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে ইউনিভার্সিটি গুলোতে ব্যাপক ব্র্যান্ডিং করলো, মেসি, রোনালদোর ক্রেজ কাজে লাগিয়ে কাস্টমারের মাথা জ্যাম করে দিল নগদের বিজ্ঞাপন দিয়ে, আর বিকাশ কি করলো বিশ্বকাপের ৬ মাস পর আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের দেশীয় স্পনসর হওয়ার জন্য বায়না ধরলো। বাংলাদেশে বিশ্বকাপের বছর ছাড়া ফুটবল নিয়ে সেই পরিমাণ উন্মাদনা কখনোই থাকে না, তাই দেশের পঙ্গু প্রায় ফুটবল বাদ দিয়ে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলকে স্পন্সর করা কিভাবে কমপিটিটরের স্ট্রং মুভ ব্লক করে তা আমি জানি না। এরপর আবার সেদিন পত্রিকায় দেখলাম সরকার স্পন্সর মানিও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ফ্রিজ করে দিয়েছে।
এই পয়েন্ট তাই বিকাশের বিপক্ষে।
নগদ: নগদের বর্তমান মার্কেট শেয়ার প্রায় ১৮%। মার্কেট শেয়ার ও কাস্টমারের TOMA বিবেচনায় নগদ এই মার্কেটের সেকেন্ড বিগেস্ট প্লেয়ার বা বলা যায় মার্কেট চ্যালেঞ্জার। মার্কেট চ্যালেঞ্জার নিবে 'অফেন্সিভ ওয়ারফেয়ার স্ট্র্যাটেজি'। চলুন দেখি নগদ কি করেছে।
১. " মার্কেট লিডারের শক্তির জায়গা খুঁজে বের করা।"
অফেন্সিভ মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির প্রথম দর্শনই হচ্ছে নিজের শক্তি বা দুর্বলতার জায়গা না খুঁজে মার্কেট লিডারের 'শক্তি'র জায়গা কনসিডার করা।
বিকাশের শক্তির জায়গা দেশব্যাপী লাখের কোটায় এজেন্ট এবং কোটির কোটায় গ্রাহক, যাদের অধিকাংশ বাস করে গ্রামে, যারা মোবাইলের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনে ইতোমধ্যে ভরসা করে ফেলেছে বিকাশকে।
নগদ বিকাশের এই শক্তির জায়গা খুব যথাযথ ভাবেই বুঝতে পেরেছে বলেই আমার মনে হয়। কারণ, নগদ মার্কেটে নামার আগেও বিকাশ ছাড়া রকেট, শিওরক্যাশের মত আরও কিছু প্ল্যাটফর্ম ছিল কিন্তু গ্রামের একজন অল্প শিক্ষিত সাধারণ মানুষ অর্থ লেনেদেনে তাদের উপর খুব একটা ভরসা করতে পারেনি, নগদ মার্কেটে নামে 'ডাক বিভাগ'-এর নাম বড় করে ব্যবহার করে। সাধারণ মানুষ আর কোন প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করতে না পারলেও সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে চোখ বন্ধ করেই বিশ্বাস করতে পারে, এছাড়াও ডাক বিভাগের সঞ্চয় পত্র, ডিপোজিট ইত্যাদি সার্ভিসের সাথেও সাধারণ মানুষ আগে থেকেই পরিচিতও ছিল। তাই নগদ অন্যান্য MFS এর তুলনায় কম সময়েই সাধারণ মানুষের ভরসা অর্জন করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
এই পয়েন্ট তাই ক্লিয়ারলি নগদের পক্ষে।
২. "মার্কেট লিডারের শক্তিমত্তার জায়গায় একটি দুর্বলতা খুঁজে বের করে সেই পয়েন্টই আক্রমণ করা।"
বিকাশের একটি শক্তির জায়গা একটু আগেই যেটি বললাম তা হলো 'দেশব্যাপী লাখো এজেন্ট'। এই ক্রম বর্ধমান নেটওয়ার্কের একটি লুপহোল আছে, আর তা হলো উচ্চহারে কমিশন। বিকাশের আয়ের প্রধান উৎস হলো ১.৮৫% ক্যাশআউট চার্জ। এই ক্যাশ আউট চার্জের একটা বড় পোরশন কিন্তু যায় এই এজেন্টদের কমিশনের পেছনেই যা প্রায় মোট আয়ের ৭৭%, সব বাদ দিয়ে বিকাশ আয় করে ১৬% মতো। নগদ বিকাশের এই শক্তির জায়গাটাতেই খুঁজে পেয়েছে একটি দুর্বলতা, আর তা হলো ক্যাশআউট চার্জ। নগদ ক্যাশআউট চার্জ এমন একটা জায়গায় কমিয়ে এনেছে যে এখন বিকাশ যদি এই রেটকে ম্যাচ করতে চায় তাহলে বিকাশের এজেন্টদের কমিশনের পার্সেন্টেজ থেকে রেভিনিউ কাট ডাউন করতে হবে, আর কমিশন কাট ডাউন করলে এজেন্ট কমে যাবে, বিকাশের জন্য এ এক উভয় সংকট বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।
সার্বিক বিবেচনায় এই পয়েন্টেও তাই নগদ জয়ী।
৩. "ক্ষুদ্র পরিসরে তীব্র আক্রমণ।"
অফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজির তিন নম্বর রুলস হচ্ছে, সরাসরি মাঝখানে নয় কিংবা বৃহৎ পরিসরে নয়, চ্যালেঞ্জারকে মার্কেট লিডারের ক্ষুদ্র একটা জায়গা টার্গেট করে সেখানে তীব্রভাবে আক্রমণ করতে হবে। নগদ কিন্তু এই কাজটিও করেছে বেশ সফলভাবে। MFS ইন্ডাস্ট্রির বেসিক সার্ভিস ক্যাশইন-ক্যাশআউট এর থেকে নগদের টার্গেট ছিল মার্চেন্ট পেমেন্টের কাস্টমারদের দিকে, যেকারণে নগদ মার্চেন্ট পেমেন্টে যে পরিমাণ ক্যাশব্যাক অফার দিত তা বিকাশ দিতে পারতো না। ফলে বিকাশের একটা বড় চাংক বিকাশের পাশাপাশি মার্চেন্ট পেমেন্টের ক্ষেত্রে নগদ ব্যবহার শুরু করে। বিকাশ পরে কিছু কিছু জায়গায় অফার ম্যাচ করলেও কাস্টমার মাইন্ডে "নগদে ক্যাশব্যাক অফার ভালো পাওয়া যায়" এরকম একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
তাই, এই পয়েন্টে আমার কাছে নগদ এবং বিকাশ ৫০-৫০।
প্রেডিকশন: 'মার্কেটিং ওয়ারফেয়ার' বই, স্ট্যাটিসটিকস এবং কিছু ক্ষেত্রে আমার অনুমানের আলোকে বলা যায় বিকাশ হয়ত কমিকস এর সেই প্রতিষ্ঠিত সুপার হিরো, যে মাস্ক পরে ঘুরলেও সবাই চেনে, কেপ পরে ঊড়ে, যে সাধারণ জনগণের স্বার্থে (এবং স্বীয় স্বার্থে) ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করে, নতুন মার্কেট তৈরি করে, ইনোভেটিভ প্রডাক্ট নামায়, লোকের চোখে সে হিরো। কিন্তু নগদ হলো কমিকস-এর সেই সুপারহিরো যে ছলে বলে কৌশলে, লোক চক্ষুর আড়ালে মার্কেটিং-এর মাস্টার স্ট্রোক ব্যবহার করে মার্কেট শেয়ার দখল করে। নগদ সেই সুপার হিরো যে তথাকথিত মাস্ক পরিহিত সুপারহিরোদেরকেও সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড় করাতে বাধ্য করায়।
[পুনশ্চঃ আমি নগদ কিংবা বিকাশ কোথাও জব করি না। একজন মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিং ইনথুজিয়াস্ট হিসেবে মনের ভাব ব্যক্ত করেছি। ভুলভ্রান্তি মার্জনা সাপেক্ষে গঠনমূলক আলোচনা/সমালোচনা করা যেতেই পারে এ বিষয়ে]
লেখক: ক্রিয়েটিভ এন্ড ব্র্যান্ড ম্যানেজার, কাজী ফার্মস লিমিটেড