২২ মে ২০২৩, ২০:৩৫

ভাগ্য-বিধির বেড়াজালে ৪০তম বিসিএস নন ক্যাডার

লেখক  © ফাইল ছবি

কবি দাউদ হায়দার লিখেছিলেন-"জন্মই আমার আজন্ম পাপ"।এই কথাটিই যেন আষ্টেপৃষ্ঠে  সত্য হতে চলেছে পাচ বছর অতিক্রম করতে যাওয়া দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সময় ক্ষেপণ করা ৪০তম বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীদের জন্য। গত বছরের মার্চে ক্যাডার পদের রেজাল্ট প্রকাশ হলেও এখন পর্যন্ত কোনো নন-ক্যাডার পদের তালিকাও প্রকাশ করতে পারেনি সরকারি চাকরির নিয়োগে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন(বিপিএসসি)।

৪০তম বিসিএসটি শুরু থেকেই নানা কারণেই আলোচিত। এই পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে।প্রায় সাত মাস পর প্রবল ঘূর্ণিঝড় ফণীর মধ্যেই ৩রা মে অনুষ্ঠিত হয় এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা।আবার প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সাত মাস পর ২০২০ সালের ৪ঠা জানুয়ারীতে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।তারপর সুদীর্ঘ এক বছরের অধিক সময় পর ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারিতে ১ম ধাপের ভাইভা পরীক্ষা শুরু হলেও বৈশ্বিক করোনা মহামারীর কারণে একই বছর ২৯ মার্চ বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন তাদের এক নোটিশের মাধ্যমে ভাইভা স্থগিতের ঘোষণা দেয়। এই ফাঁকে মে মাসে জরুরী কারণে ডাক্তার নিয়োগের লক্ষে অনুষ্ঠিত হয় ৪২তম (বিশেষ) বিসিএসের ভাইভা। ৪০তম বিসিএসের প্রথম ধাপের ভাইভা স্থগিতের দীর্ঘ ছয় মাস পর করোনার প্রভাব কিছুটা হ্রাস পেলে আবারও এই বিসিএসের ভাইভা শুরু হয় ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। কিন্ত ৪১তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা ও পিএসসি’র বার্ষিক রিপোর্ট সংক্রান্ত কাজের  জন্য আবারও বিরতি দিয়ে পরবর্তী ধাপের ভাইভার জন্য নোটিশ দেয়া হয়। সেই নোটিশ অনুযায়ী মৌখিক পরীক্ষা পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অনিবার্য কারণবশত ৩১ জানুয়ারী ২০২২ তারিখে আবারও এই বিসিএসের মৌখিক তথা ভাইভা পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।অবশেষে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে ২০২২ সালের মার্চ গিয়ে শেষ হয় এই বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা। এবছরের ৩০ মার্চ দশ হাজারের অধিক ভাইভা প্রার্থী থেকে চূড়ান্ত ভাবে ১৯৬৩ জনকে ক্যাডার পদের জন্য সুপারিশ করে বিপিএসসি।উপর্যুক্ত সমীকরণটি লক্ষ্য করলে সহজেই অনুমেয় যে এই ৪০তম বিসিএসের প্রার্থীদের কতটা অবহেলা এবং কতটা দূর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়েছে।এই বিসিএসের মধ্যেই বিভিন্নভাবে ধারাবাহিক কার্যক্রম স্থগিত রেখে সম্পন্ন হয়েছে তার পরবর্তী ৪২ তম বিসিএস(বিশেষ) এবং ৪১ তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার কার্যক্রম।গত পাচ বছর পরিশ্রম ও ধৈর্যের সাথে টিকে থেকেও পদ স্বল্পতায় যারা ক্যাডার পদ পেলেন না তারাই হলেন হতাভাগা বিসিএস নন-ক্যাডার প্রার্থী।
অর্থাৎ যে চার লক্ষের অধিক প্রার্থী থেকে প্রিলিমিনারি,লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা তথা মোট পনেরো শ নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও পদ স্বল্পতায় বিসিএস ক্যাডার হতে পারেননি তারাই হলেন নন-ক্যাডার প্রার্থী। ৪০তম বিসিএসে এই নন ক্যাডার প্রার্থীদের সংখ্যা আট হাজারের অধিক,যদিও চাকুরী প্রত্যাশীর সংখ্যা ছয় হাজারের কিছু বেশি।যাদের অনেকেই হারিয়েছেন এই দীর্ঘ যুদ্ধে তাদের বয়স ও শ্রম। ইতোপূর্বে এই বিসিএস ‘নন-ক্যাডার’ থেকে তারা সাধারণত খালি হাতে ফিরতেন। তাই যারা বিসিএস পরীক্ষার কঠিন ধাপগুলো সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েও পদ স্বল্পতার কারণে চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন না তাদের জন্য সরকার কর্তৃক ‘নন-ক্যাডার’ বিশেষ নীতিমালা প্রণীত হয়।

সরকার কর্তৃক জারিকৃত ‘নন-ক্যাডার’ পদের নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা-২০১০ এবং সংশোধিত বিধিমালা-২০১৪ অনুযায়ী সরকারের বিভিন্ন দফতর থেকে শূন্য পদের চাহিদা পাওয়া সাপেক্ষে পিএসসি প্রথম ও দ্বিতীয় (১০-১২ গ্রেড) শ্রেণিতে সুপারিশ করে থাকে।৩১তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারে নিয়োগ শুরু হয় এবং উল্লেখযোগ্য হারে শুরু হয় ৩৪তম বিসিএস থেকে।

ক্যাডার পদ না পেলেও অন্তত দীর্ঘ পরিশ্রম ও সময় শেষে এই নন ক্যাডার চাকরিই তাদের সান্ত্বনা। কিন্তু বিসিএস উত্তীর্ণ হলেও তাদের ভাগ্যে আদৌ চাকরি আছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের স্বদিচ্ছা এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়,দফতর বা বিভাগের চাহিদার উপর নির্ভর করে তাদের চাকরি পাওয়া-না পাওয়া।তবে এই ৪০ তম বিসিএসের "জন্মই যেন আজন্ম পাপ" তাই ফণী ঘূর্ণিঝড় আর করোনা মহামারীর সাথে লড়ে যাওয়া প্রার্থীদের ভাগ্য কখনোই সুপ্রসন্ন হয়নি।অন্যান্য সময় সাধারণত বিসিএস ক্যাডার পদের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের স্বল্প সময়েও নন- ক্যাডার পদের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলেও এখানেও বঞ্চনার শিকার সেই হতভাগা ৪০তম বিসিএস।যেখানে ৩৮তম বিসিএস চূড়ান্ত ফল প্রকাশের ১৩ দিন পর বিপিএসসি নন-ক্যাডার পদের অনলাইন আবেদনপত্র আহবান করে,সেখানে ৪০তম বিসিএস চূড়ান্ত ফল প্রকাশের তিন মাস পর নন-ক্যাডার পদের অনলাইন আবেদনপত্র আহবান করে।

উল্লেখযোগ্য পদ পাওয়ার পরও ৪০ তম বিসিএস  নন-ক্যাডার প্রার্থীদের সুপারিশ না করে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন নন-ক্যাডার পদের নিয়োগ সংশোধিত (বিশেষ) বিধিমালা-২০২২ এর জন্য সভা ডেকে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত করতে বিসিএস ক্যাডার পদের সাথে একই সময় ওই বিসিএসের নন-ক্যাডারের পদেরও সুপারিশ করবে বাংলাদেশ কর্মকমিশন। ৪৫তম বিসিএস থেকে এই প্রক্রিয়া চলমান। নন-ক্যাডার নিয়োগ কার্যক্রমের বৈধতা চেয়ে গত বছরের ২৩ আগস্ট পিএসসি থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, বিসিএসে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের আগে যত শূন্য পদই আসুক, তা একটি বিসিএসে নিয়োগ দিয়ে শেষ করা যাবে না। কোন শূন্য পদ কোন বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় এসেছে, তা বিবেচনায় আনতে হবে।

এই নতুন বিধিমালাকে কেন্দ্র করে বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীদের একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন পিএসসি ভবনের সামনে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যায়।তখন বিভিন্ন গণমাধ্যম মারফত তারা আশ্বস্ত হয় যে, এই বিসিএস থেকেই সর্বোচ্চ সংখ্যকপ্রার্থী চাকরি পাবেন। এতে তারাও আন্দোলন ছেড়ে নতুন বিধি পাশ ও ফল প্রকাশের অপেক্ষা করতে থাকে।

নতুন বিধি অনুযায়ী এখন থেকে নতুন বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার পদের পাশাপাশি নন-ক্যাডার পদের সংখ্যাও উল্লেখ থাকবে। ৩৫তম থেকে ৪৪তম বিসিএসের নন-ক্যাডার নিয়োগের বৈধতা চাওয়া হয় ওই চিঠিতে। নতুন বিধি সংশোধন হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে তা চূড়ান্ত করা হলে পরবর্তী নন-ক্যাডার নিয়োগ দিতে পারবে পিএসসি। ওই বিধি এখনও পাস না হওয়ায় ঝুলে আছে হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থীর ভাগ্য।

নতুন বিধিমালা এখনও অনুমোদন না হওয়ায় ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডার নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ আছে। বিধিমালা জারি হলেই ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার ফলাফল বিধিমালার আলোকে প্রকাশ করতে পারবে পিএসসি।

এরই মধ্যে চার ধাপে নন-ক্যাডার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে চার সহস্রাধিক চাহিদা পেয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। উত্তীর্ণ ৮ হাজার ১৬৬ জনের মধ্যে নন-ক্যাডার পদে ৪০ম বিসিএসে অপেক্ষমাণ আছেন ৬ সহস্রাধিক পরীক্ষার্থী।

এই পরিস্থিতিতে তাদের মানবিক বিবেচনায় পদ বাড়িয়ে বেশি নিয়োগের সুপারিশ না করে বরং এই বিধিমালা বেড়াজালে দীর্ঘসূত্রতা হওয়াটাও আরও অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। যেখানে এই ৪০তম বিসিএসের জন্য চাহিদা পাওয়া পদগুলোর একটি ফল ঘোষণা করলেই এই বিসিএসের কাজ সম্পন্ন হতে পারতো সেখানে ফলাফল দীর্ঘমেয়াদী করে নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের যে মন্থর গতি তা অমানবিক ও অপ্রত্যাশিত বলে পরিগণিত হচ্ছে।তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিৎ এই মানবেতর পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া।তাদের একটি সিদ্ধান্তই একজন বিসিএস উত্তীর্ণ মেধাবীর জীবন জীবিকার অনুসঙ্গ। কোনোভাবেই যেন তাদের সিদ্ধান্ত ঘূর্ণিঝড় ফণী বা করোনার মত মহামারী হয়ে ৪০তম বিসিএস উত্তীর্ণদের আর আঘাত না করতে পারে সেদিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে আরও মনোযোগী হতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট ও নাট্যকার
ই-মেইল: kabilsadi@gmail.com