পুরো এক বছর একটা সেকেন্ডও যাতে নষ্ট না হয় সে চেষ্টা করেছি
আজকে আমি আমার চাকরির গল্পটা বলবো। ২০১৮ সাল, তখন মাস্টার্সের সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। পরীক্ষার মাঝে সাব-ইন্সপেক্টর পরীক্ষার রিটেন। বাসায় কাউকে না জানিয়ে পরীক্ষার জন্য আবেদন করেছিলাম, শারীরিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি, তারপর রিটেন দিয়েছি। লিখিত পরীক্ষা ভালো হয়েছিল জন্য জানতাম ভেরিফিকেশন হবে সেজন্য বাসায় বলাটা জরুরি ছিল। এরপর মাস্টার্সের ডিফেন্স দেওয়ার আগেই সাব ইন্সপেক্টরের বেসিক ট্রেনিং করতে সারদা গেছি। ট্রেনিং থেকে ছুটি নিয়ে মাস্টার্সের ডিফেন্স দিয়েছি।
জীবনে প্রত্যেকটা সেকেন্ডের যে মূল্য কতটুকু হতে পারে তা জানিয়েছিল সারদার এই পুলিশ ট্রেনিং। ট্রেনিং এর মাঝে পাওয়ার ছোট ছোট সময়গুলোতে প্রচুর পড়াশোনা করার চেষ্টা করতাম। মনে আছে, ভোর সাড়ে চারটার থেকে শুরু হওয়া পিটি, প্যারেড শেষে আমাদের আইনের ক্লাস শুরু হতো দশটায়। চার ঘন্টা টানা চলতো এই ক্লাস। পিটি প্যারাটের ক্লান্তিতে যখন সবার চোখে ঘুম, জোর করে চোখ মেলে রেখে তখন প্রিপারেশন নিয়েছি জবের।
আশেপাশে অনেকেই ছিল বিসিএস এর ভাইভা, রিটেন দেওয়া। তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, তাদের পড়ার স্টাইল গুলো ফলো করতাম। মূলত গোছানো প্রিপারেশনের যাত্রা শুরু হয়েছে তাদেরকে দেখেই। এরপর বিকেলের প্যারেটের পরে সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত আবার আইনের ক্লাস। সেখানেও চেষ্টা করতাম বই পড়তে। ট্রেনিং এর ফাঁকে থাকা ছোট গ্যাপগুলাতেও পকেট নোটে পড়া টুকে নিতাম। পুরো এক বছর ধরে একটা সেকেন্ডও যাতে নষ্ট হয় সে চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি পুরোদমে সময়গুলোকে কাজে লাগানোর।
পুলিশের জবে ঢোকার আগেই স্বপ্ন ছিল পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে চাকরি করার। সে স্বপ্ন পূরণ করতে আমার কাছে একটাই রাস্তা ছিল। ট্রেনিংয়ে মেধাক্রমে ১০০ এর মধ্যে আসা। ট্রেনিংয়ে ১৭৫৯ জনের মধ্যে আমার পজিশন ছিল ৯ম। সেই সুবাদে স্বপ্নের পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে। কাছ থেকে দেখেছি পুলিশের বড় বড় অফিসারদের। তাদের চলার স্টাইল আমাকে মুগ্ধ করেছে সব সময়।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে আমার সব থেকে পছন্দের জায়গা ছিল লাইব্রেরী। গবেষণার কাজে মোটামুটি পারদর্শী হওয়ায়, সে শাখাতেই পোস্টিং নিতে পেরেছিলাম। গবেষণার ডেস্ক জব করে তার পাশাপাশি প্রিপারেশন নিতে পেরেছিলাম সেখানেও। কম্পিউটারে কাজ চলছে আর সামনে সবসময় একটা বই খোলা। স্বপ্ন ছিল একজন বড় পুলিশ অফিসার হওয়ার। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের আমার কলিগদের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ।
ইপেপার, ফেসবুক, বিভিন্ন জব গ্রুপ, বই থেকে নেওয়া তথ্যগুলো দিয়ে রাত জেগে তৈরি করতাম নোট খাতা। ইপেপার থেকে প্রয়োজনীয় অংশগুলো প্রিন্ট করে রাখতাম ফাইলে। নীলক্ষেত থেকে কেনা প্যাডগুলোতে নোট করে নিতাম সংবাদের বড় বড় অংশগুলো। গাইড বইয়ের থেকে এই নোটখাতাগুলোই পড়া হয়েছে বেশি। শুক্র আর শনিবার অফিস ছুটি হওয়ার কারণে প্রায় প্রত্যেক শুক্রবারে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের চেষ্টা করতাম। সামনে আসা ৯ম, দশম গ্রেডের সব সার্কুলার আবেদন করতাম শুধুমাত্র পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। মনে আছে যখন পরীক্ষা থাকতো না সে শুক্রবার গুলো বোরিং যেত। পরীক্ষা দেওয়া এক প্রকার নেশায় পরিণত হয়েছিল।
৪১,৪৩,৪৪ বিসিএস পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকেই দেওয়া। আমার রেজাল্টে আমার থেকে বেশি খুশি হতো আমার কলিগগুলো। অফিস থেকেই কয়েকবার বাংলাদেশ ব্যাংকে গেছি ব্যাংকের ভাইভা দিতে। ঢাকায় চাকরি করার ইচ্ছা থাকায় ঢাকার বাহিরে গিয়ে জব করতে হবে এরকম জবের প্রতি আগ্রহ ছিল কম। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে জব করা অবস্থাতেই প্রায় ১০/১২ টা ভাইভা দিয়েছি।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ছাড়লাম ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে উপ-কর কর্মকর্তা পদে জয়েন করার জন্য ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে। মেরিট পজিশন ২য়। লক্ষ্য এখনও অটুট, স্বপ্ন বিসিএস পুলিশ ক্যাডার। রাজউকে সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হলাম, পজিশন সম্ভবত ১ম। এটা সুপারিশপ্রাপ্ত ৫ম চাকরি। যে চাকরিগুলোকে একসময় স্বপ্ন ভাবতাম, টাকা/লিংক ছাড়া এ চাকরিগুলো হয় না ভাবতাম সে চাকুরিগুলো করতে পারছি। বিধাতার কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া...
লেখক: উপ-কর কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন
সুপারিশপ্রাপ্ত, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
সাবেক শিক্ষার্থী, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাভাবিপ্রবি