এখন আমাদের অনেক প্রয়োজন ছিল অথচ চলে গেলেন তিনি
বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, স্বাধীনতা সংগ্রামে তার উল্লেখযোগ্য অবদান এবং স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের নীতির প্রতি তার অটল অঙ্গীকারের জন্য বিশেষ শ্রদ্ধার যোগ্য। গত মঙ্গলবার রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি.... রাজিউন) আমরা তার অসাধারণ জীবনকে সম্মান করি, আসুন আমরা তার উত্তরাধিকারের প্রতি চিন্তা করি এবং তার অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আশি ও নব্বই এর দশকে লেখকের সাথে বাংলাদেশের তৃণমূলে মানবাধিকার আন্দোলন গড়ে তোলার প্রাক্কালে ফাদার আর. ডব্লিউ টিমের সাথে সম্পর্কের সুবাদে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভাইয়ের সাথেও বেশ কয়বার আলাপ আলোচনা ও মেলামেশার সুযোগ হয়. সুযোগ হয় সাংবাদিকতা পেশার সূত্রেও। সে স্মৃতিকাতরতা ও আবেগ নিয়ে ভারাক্রান্ত মনে কিছু লেখার প্রয়াস।
১৯৭১ সালে ভারতের মাটিতে, আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে স্বাধীন বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কারক হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। দৈনিক যুগান্তর ১২ এপ্রিল ২০২৩ দেশের জন্য তার যে আত্মত্যাগ তা তুলে ধরেছে।
"দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামে ফিরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতালটি গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র নামে গড়ে তোলেন কুমিল্লায়। পরে সেটা স্থানান্তর করেন ঢাকার সাভারে। এ ‘গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র’ নামটি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।...প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে সেবা দিতে প্যারামেডিকেল শিক্ষা দিয়ে এতে মাঠ পর্যায়ের জনগণকে সম্পৃক্ত করেন ডা. জাফরুল্লাহ।...এ বিষয়ে ১৯৭২ সালে ধারণাপত্র প্রকাশ করেন তিনি। যা ১৯৭৮ সালে কাজাকিস্তানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অ্যালমাটা ঘোষণায় স্বীকৃতি পায়। তিনিই প্রথম দেশে গ্রামীণ স্বাস্থ্যবীমা চালু করেন।
সবার জন্য সুলভমূল্যে ওষুধ নিশ্চিত করতে তিনি প্রণয়ন করেন ওষুধ নীতি। যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের বর্তমান ওষুধ শিল্প। ১৯৮২ সালে প্রণীত ওষুধ নীতির অন্যতম রূপকার ছিলেন প্রতিভাবান এই চিকিৎসক।...কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জীবনের নানা পর্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার বা সম্মাননা পেয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয় সরকার। ফিলিপাইনের র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে। ১৯৯২ সালে সুইডেন থেকে তাকে দেওয়া হয় রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড।...কানাডার ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব ন্যাচারাল মেডিসিন ২০০৯ সালে দেয় ডক্টর অব হিউম্যানিটেরিয়ান উপাধি। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে থেকে ২০১০ সালে দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ অ্যাওয়ার্ড।
ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যেটি প্রতিবেশী ভারতে পালিয়ে আসা লাখ লাখ উদ্বাস্তু গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সহায়তা প্রদান করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে বাঁচার জন্য। রাজনৈতিক চাপ এবং ব্যক্তিগত ঝুঁকি সহ প্রচুর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও, ডা. জাফরুল্লাহর অক্লান্ত প্রচেষ্টা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আন্তর্জাতিক সচেতনতা এবং সমর্থন বাড়াতে সাহায্য করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা পাশাপাশি, ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার কর্মজীবন জুড়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য একজন বিশিষ্ট উকিল ছিলেন। একজন চিকিত্সক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসাবে, তিনি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক কল্যাণের উন্নতির প্রচেষ্টার অগ্রভাগে ছিলেন । তিনি সমাজে দুর্নীতি, অবিচার এবং বৈষম্যের সোচ্চার সমালোচক ছিলেন এবং নিপীড়ন ও অসমতার বিরুদ্ধে নির্ভয়ে কথা বলেছেন।
স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের নীতি এর প্রতি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অটল অঙ্গীকার তাকে বাংলাদেশ এবং বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা ও সম্মান অর্জন করেছে। তার সাহস, স্থিতিস্থাপকতা এবং সমাজের উন্নতির জন্য অটল উৎসর্গ বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রজন্মের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করে।
ডক্টর জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার সাথে সাথে, আসুন আমরা স্মরণ করি এবং শ্রদ্ধা জানাই মুক্তি সংগ্রামে তাঁর অদম্য অবদান, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের প্রতি তাঁর আজীবন অঙ্গীকার এবং বাংলাদেশের জনগণের মঙ্গলের প্রতি তাঁর অটল উৎসর্গকে। তিনি চিরকাল একজন সত্যিকারের নায়ক এবং আগামী প্রজন্মের জন্য আশার আলোকবর্তিকা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর উত্তরাধিকার দীর্ঘজীবী হোক, এবং তাঁর আদর্শ আমাদের সকলকে অনুপ্রাণিত করতে থাকুক।
ডাঃ জাফরুল্লাহর নেতৃত্বে, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র জনস্বাস্থ্যের ফলাফলের উন্নতির লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্ভাবনী কর্মসূচি ও বাস্তবায়ন করেছে। বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের উপর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্যোগের কিছু প্রভাবের মধ্যে রয়েছে:
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা: গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এবং অনুন্নত এলাকার প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র স্থাপন করেছে, যে সকল সম্প্রদায়ের মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা অ্যাক্সেস নেই তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে। এই কেন্দ্রগুলি মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা, টিকাদান, পুষ্টি সহায়তা, এবং সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা সহ ব্যাপক স্বাস্থ্য পরিষেবা সরবরাহ করে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতা: গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্বাস্থ্যকর আচরণের প্রচার এবং গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করেছে। এই প্রোগ্রামগুলির মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যবিধি, পুষ্টি, প্রজনন স্বাস্থ্য, শিশুর যত্ন এবং রোগ প্রতিরোধের মতো বিষয়গুলির প্রচারাভিযান, যা সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাস্থ্য জ্ঞান এবং অনুশীলনগুলো উন্নত করতে সাহায্য করেছে।
কমিউনিটি মোবিলাইজেশন: গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কমিউনিটি মোবিলাইজেশন প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে তার স্বাস্থ্য উদ্যোগে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন, স্বাস্থ্য স্ক্রীনিং পরিচালনা এবং তাদের স্বাস্থ্য ও মঙ্গল সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া সম্প্রদায়কে জড়িত করা।
অ্যাডভোকেসি এবং নীতির প্রভাব: গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত নীতি ও সংস্কারের পক্ষে ওকালতি তে জড়িত। ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র জনস্বাস্থ্যে সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধি, উন্নত স্বাস্থ্য সেবা অবকাঠামো, এবং সকল নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবার ন্যায়সঙ্গত অ্যাক্সেসের জন্য সোচ্চার উকিল।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্যোগের প্রভাব উল্লেখযোগ্য, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ফলাফলের উন্নতিতে। জনস্বাস্থ্যের প্রতি সংগঠনের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা, সম্প্রদায়ের সংহতি এবং নীতির সমর্থনে অন্তর্ভুক্ত করে, স্বাস্থ্যের বৈষম্য মোকাবেলা করতে এবং দেশে স্বাস্থ্য সমতা উন্নীত করতে সাহায্য করেছে।
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্ব এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবদান জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। সকলের জন্য জনস্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা অ্যাক্সেসের উন্নতির জন্য তার উত্সর্গীকরণ, বিশেষ করে প্রান্তিক এবং দুর্বল জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশের জনগণের স্বাস্থ্য ও মঙ্গলের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।
ডক্টর অব হিউম্যানিটেরিয়ান অগ্রজ জাফরুল্লাহকে এখন আমাদের অনেক প্রয়োজন ছিল অথচ তিনি চলে গেলেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও পরিষেবার সংস্কার নিয়ে আমরা যা ভাবছি তিনি অনেক আগেই তা ভেবে রেখেছেন তাকে এ বিদায়বেলায় স্বাধীনতার রক্তিম স্যালুট।
[লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার, সভাপতি, বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক, স্পেশাল প্রজেক্ট কমিটি চেয়ার, স্টেপ টু হিউম্যানিটি এসোসিয়েশন কানাডা নিবাসী]