অধ্যাপক ছেলের শিক্ষক বাবা, তাঁর চার ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য

অধ্যাপক ড. সুশান্ত কুমার দাস
অধ্যাপক ড. সুশান্ত কুমার দাস  © সংগৃহীত

আজ কোনও কারণ ছাড়াই আমার বাবার কথা মনে পড়লো। আমার বাবা একজন ‘শিক্ষক’ ছিলেন। শিক্ষক শব্দটার ওপর জোর দিলাম। কারণ বাবার একজন ছাত্রও ছিল না (যাদের আমি দেখেছি) যারা বলেননি, ‘স্যার, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক’। বাবা ৫০ বছরের বেশি সময় শিক্ষকতা করেছেন। সম্ভবতঃ আমি বাবার সবচাইতে কাছের ছাত্র। আমার অক্ষর জ্ঞান হয় বাবার বুকের উপর শুয়ে শুয়ে।

আমি কোনদিন বর্ণমালা কোন বই থেকে শিখিনি। কি করে বাবার মুখে মুখে শিখেছি। আর বাকিটা আমার দিদির পড়া শুনে শুনে। সোমারফিল্ড বা জে জে থমসনের অনেক ছাত্র নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। একটা পাড়াগাঁয়ের স্কুলের শিক্ষক আমার বাবার চারজন ছাত্র উপাচার্য হয়েছেন। সম্ভবতঃ বাংলাদেশে এমনটা আর নেই।

বাবা ছিলেন প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। ১৯২৩ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংক,বাংলা ও সংস্কৃতে লেটারসহ স্টার মার্ক পেয়ে পাশ করেছিলেন। এক অজ পাড়াগায়ে যেখানে তিনি ছাড়া কেউ শিক্ষিতই ছিল না।

আরো পড়ুন: শিগগিরই নন-ক্যাডারের প্রার্থীরা বড় সুখবর পাবেন—পিএসসি চেয়ারম্যান

বাবা কবি ছিলেন, প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন অংকে। তাঁর মতো নির্ভুল বাংলা, ইংরেজি এবং সংস্কৃত লেখা মানুষ আমি দেখিনি। একটুও বাড়িয়ে বলছি না। ইংলিশ টু বাংলা ডিকশিনারির কোন শব্দ তাঁর অজানা ছিল না। বাবা উচ্চ শিক্ষায় যাননি তাঁর এলাকায় স্কুল করবেন বলে। আমি তাঁর গড়া স্কুল থেকে প্রথম এসএসসি পাশ করেছিলাম। আমাদের এলাকায় সকল শিক্ষিত মানুষই ছিল বাবার ছাত্র।

একজন মানুষ শুধু অন্যদের শিক্ষিত করবেন বলে নিজের সকল উচ্চাকাংক্ষা বিসর্জন দিয়েছিলেন। বাবাকে কোনদিন হা-হুতাশ করতে দেখিনি। আমার মায়ের মৃত্যুর পর তিনি লেখাপড়া ছাড়া সংসারের আর কোনকিছুতেই মন বসাননি।

আমার ভাই বোনেরা কেউ এদেশে না থাকায়, তাকেও চলে যেতে হয়েছিল। '৭১ সালেও যে দেশ ছেড়ে তিনি যাননি, সেই দেশ তাঁকে ছাড়তে হয়েছিল, সেটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাঁর কথা আমি বুঝতাম গভীরভাবে, কিন্তু তিনি কাউকে কিছু বলেননি কোনোদিন। আজ আমারো প্রায় জীবন সায়াহ্নে বাবার কথা মনে হচ্ছে।

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

(ফেসবুক থেকে)


সর্বশেষ সংবাদ