উচ্চ আদালতের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি, নিয়োগবঞ্চিত ১৩তম নিবন্ধনের ২৫০০ প্রার্থী

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও এনটিআরসিএ লোগো
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও এনটিআরসিএ লোগো  © ফাইল ছবি

১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আড়াই হাজারের বেশি প্রার্থীকে নিয়োগ সুপারিশের নির্দেশনা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। রায় দেওয়ার ১১ মাস অতিক্রম হলেও তা বাস্তবায়নে উদাসীন বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। চাকরি না পেয়ে চরম হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন এই নিবন্ধনধারীরা। ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতে তাদের জন্য পদ সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন তারা।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, একই ব্যাচের ২২০৭ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হলেও ২৫০০ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করছে না এনটিআরসিএ। এক্ষেত্রে একদেশে দুই আইন বাস্তবায়ন করছে এনটিআরসিএ। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ না হওয়ায় পরিবার নিয়ে চরম কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাদের। দ্রুত আদালতের দেওয়া রায় বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তারা।

এনটিআরসিএ বলছে, ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধনের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালের ৪ জুন। নিবন্ধনের নীতিমালা অনুযায়ী নিবন্ধন সনদের মেয়াদ তিন বছর। কাজেই ১৩তম নিবন্ধনে উত্তীর্ণদের সনদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কাজেই তাদের নিয়োগ সুপারিশের সুযোগ নেই। যদিও একই ব্যাচের ২২০৭ জনকে ২০২২ সালে নিয়োগ সুপারিশ করেছিল এনটিআরসিএ।

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানছে না এনটিআরসিএ। আমাদের সরাসরি নিয়োগের কথা বলে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। আমরা নম্বর এবং মেধাতালিকায় এগিয়ে থেকেও নিয়োগ বঞ্চিত হয়েছি। আমাদের নিয়োগ সুপারিশ করতে একাধিকবার এনটিআরসিএতে স্মারকলিপি দিয়েছি। তবে আজও আমাদের নিয়োগ হয়নি—মশিউর রহমান, ১৩তম নিবন্ধনধারী

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহিল আজম বলেন, ২৫০০ জনের বিষয়ে আদালত কী রায় দিয়েছেন সেটি আমি দেখিনি। রায় না দেখে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ৫ লাখ ২৭ হাজার ৭৫৪ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। ২০১৭ সালের ৪ জুন ১৩তম নিবন্ধনের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়। এতে ১৭ হাজার ২৫৪ জন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়। শূন্য পদের বিপরীতে সরাসরি নিয়োগের জন্য ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধনধারীদের নির্বাচিত করা হলেও নিয়োগ সুপারিশ না করায় ২০১৭ সালে ২২০৭ জন প্রার্থী হাইকোর্টে রিট করেন। 

শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক

২০১৮ সালে রিটকারীদের নিয়োগের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। ওই রায়ের ওপর এনটিআরসিএ আপিল করলে ২০২০ সালে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। আপিল বিভাগের রায় বাস্তবায়নে এনটিআরসিএ ২০২১ সালের ৩১ মার্চ তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এবং ওই বিজ্ঞপ্তিতে ২২০৭ জনের জন্য শূন্য পদ সংরক্ষণ করে। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তাদের নিয়োগ সুপারিশ করা হয়। পরবর্তীতে নিয়োগ বঞ্চিতদের মধ্যে আরও আড়াই হাজার প্রার্থী রিট করেন। এই রিটকারীদেরও নিয়োগের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। 

২২০৭ জন এবং ২৫০০ জনের মামলার গ্রাউন্ড একই। রায়ও একই। তবে একটি গ্রুপকে নিয়োগের সুপারিশ করা হলেও তাদের সুপারিশ করা হচ্ছে না। অথচ প্রাপ্ত নম্বর এবং মেধাতালিকায় ২৫০০ জন এগিয়ে রয়েছেন। আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য একাধিকবার লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হলেও তার কোনো জবাব দেয়নি এনটিআরসিএ। গত ২২ ফেব্রুয়ারিও আইনজীবীর মাধ্যমে নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

২০২২ সালের ১ জুন ১৩তম ব্যাচের ২ হাজার ৫০০ জনের নিয়োগের নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। রায়ের দিন থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে নিয়োগ সুপারিশের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট বেঞ্চ। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের রায়ের বিপক্ষে লিভ টু আপিল দায়ের করে এনটিআরসিএ। আপিল শুনানি শেষে ২০২৩ সালের ২ এপ্রিল আপিল বিভাগ রিটকারীদের পক্ষে থাকা হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। ফলে হাইকোর্টর রায় অনুযায়ী আপিলের রায়ের পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে নিয়োগ সুপারিশ করার কথা, কিন্তু গত ১১ মাসেও নিয়োগের সুপারিশ করেনি এনটিআরসিএ।

ভুক্তভোগী নিবন্ধনধারীরা বলছেন, ১৩তম নিবন্ধনধারীদের ১২টি সিপির ব্যাপারে রায়ের কপির ২৯ নং পয়েন্টে বিচারপতিগণ চূড়ান্ত জাজমেন্ট দিয়েছেন। হাইকোর্টের রায়ে কোন দূর্বলতা  এবং বিকৃতি খুঁজে না পাওয়ায় আপিল বিভাগের বিচারপতিগণ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। রায়ের বিরুদ্ধে এনটিআরসিএ করা লিভ টু আপিলের কোন মেধা না থাকায় এনটিআরসিএ এর লিভ টু আপিল বিবেচনার যোগ্য মনে করেননি বিচারপতিগণ। ফলশ্রুতিতে এনটিআরসিএ আপিলে হেরে গেছে। এনটিআরসিএ আপিল বিভাগের রায়কে সন্মান জানিয়ে ১৩তমদের ১২ টি সিপির  রায় বাস্তবায়ন না করে আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর বিভাগকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে ১৩তমদের  নিয়ে একটি বিভ্রান্তকর মতামত নিয়ে এসেছেন, যেটা সত্যিই খুব দুঃখজনক।

১৩তম নিবন্ধনধারীরা অভিযোগ করে বলেন, ২২০৭ জন এবং ২৫০০ জনের মামলার গ্রাউন্ড একই। রায়ও একই। তবে একটি গ্রুপকে নিয়োগের সুপারিশ করা হলেও তাদের সুপারিশ করা হচ্ছে না। অথচ প্রাপ্ত নম্বর এবং মেধাতালিকায় ২৫০০ জন এগিয়ে রয়েছেন। আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য একাধিকবার লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হলেও তার কোনো জবাব দেয়নি এনটিআরসিএ। গত ২২ ফেব্রুয়ারিও আইনজীবীর মাধ্যমে নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

হাইকোর্ট

এ বিষয়ে মো. মশিউর রহমান নামে ১৩তম নিবন্ধনে নিয়োগ বঞ্চিত এক চাকরিপ্রার্থী বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানছে না এনটিআরসিএ। ২২০৭ ও ২৫০০ জনের রিটের সবকিছু একই হলেও ২৫০০ জনের বিষয়ে দেওয়া রায় বাস্তবায়নে এনটিআরসিএ চরম উদাসীনতা দেখাচ্ছে। গত এক বছর ধরে আমরা বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের সরাসরি নিয়োগের কথা বলে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। আমরা নম্বর এবং মেধাতালিকায় এগিয়ে থেকেও নিয়োগ বঞ্চিত হয়েছি। আমাদের নিয়োগ সুপারিশ করতে একাধিকবার এনটিআরসিএতে স্মারকলিপি দিয়েছি। তবে আজও আমাদের নিয়োগ হয়নি। 

১৩তম নিবন্ধনের আরেক ভুক্তভোগী মোঃ সেলিম ইউসুফ বলেন, আমাদের রায়টা ২২০৭ জন ১৩ তম নিবন্ধনধারীদের যে নিয়োগ হয়েছে সেই রায়ের আলোকে দেওয়া। অথচ তাদের নিয়োগ হয়েছে, আমাদের নিয়োগ হয়নি। এটি বৈষম্যমূলক আচরণ। সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল উচ্চ আদালত। সেই আদালতের নির্দেশনাও এনটিআরসিএ মানছে না। তারা কী তাহলে আইনের উর্ধে চলে গেছে?

মোহাম্মদ শাহিন আহমেদ নামে আরেক নিবন্ধনধারী জানান, নিয়োগ সুপারিশের ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে এনটিআরসিএ নানাভাবে নিবন্ধনধারীদের হয়রানি করছে। তারা নিজেরাই একেকবার একেক রকম সিদ্ধান্ত নেয়। একই ধরনের মামলায় ২২০৭ জন নিয়োগ পেলেও আমরা ২৫০০ জন নিয়োগ পাইনি। এক দেশে দুই রকম আইনের প্রয়োগ হতে পারে না। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অবিলম্বে আমাদের নিয়োগ সুপারিশ করতে হবে। তা না হলে আমরা কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব।


সর্বশেষ সংবাদ