এমপিওভুক্ত হতে ‘ভুয়া উপসচিব’কে ৪ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন শিক্ষকরা
মাদ্রাসা শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি ও নবনিয়োগপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ানদের বেতন-ভাতাদি নিয়মিত করে দেওয়ার আশ্বাসে চার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে একটি চক্র। বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য করতে শিক্ষকদের কাছে তারা নিজেদেরকে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের উপসচিব ও প্রোগ্রাম অফিসার পরিচয় দিয়েছেন। চক্রটি কাজ করে দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়ে বন্ধ করে দেন যোগাযোগ। বদলে ফেলেন মোবাইল ফোনের সিমও।
উপসচিব পরিচয়ে টাকা নেওয়া ওই ব্যক্তির নাম জুবায়ের ওরফে আসাদুজ্জামান মানিক ওরফে লুৎফর রহমান। তিনি নিজেকে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের উপসচিব, প্রোগ্রাম অফিসার আবার কখনো সিস্টেম অ্যানালিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতেন। এসব পরিচয়েই তিনি প্রতারণা করতেন। তবে এ নামে কোনো কর্মকর্তা নেই বলে নিশ্চিত করেছে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর।
সম্প্রতি প্রতারণার এসব ঘটনায় মামলা হলে অভিযান চালিয়ে দুই প্রতারককে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পরবর্তীতে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির অতিরিক্ত ডিআইজি মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের ভুয়া উপসচিব, প্রোগ্রাম অফিসার কখনো সিস্টেম এনালিস্টের পরিচয়ে মাদ্রাসা শিক্ষকদের টার্গেট করে। এরপর এমপিওভুক্তি ও নবনিয়োগপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ানদের বেতন ভাতাদি নিয়মিত করে দেওয়ার আশ্বাসে চার কোটির বেশি ঢাকা প্রতারণা করে আত্মসাৎ করেছে।
আরও পড়ুন: অক্টোবরে প্রশিক্ষণ পাবেন ‘বাদ পড়া’ ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষক
পিবিআইয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সারা দেশে অসংখ্য শিক্ষককে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। কেউই টাকা ফেরত পাননি। প্রতারণার শিকারদের একজন বাদী হয়ে ২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বংশাল থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে পিবিআই। প্রাপ্ত তথ্য ও প্রতারিতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জুবায়ের ওরফে আসাদুজ্জামান মানিক ওরফে লুৎফর রহমানকে (৪৭) ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত ২টায় গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানার ফলগাছা গ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয়।
‘তিনি নিজেকে প্রোগ্রাম অফিসার পরিচয় দিতেন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অপর সহযোগী আব্দুল গফফার ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে সাইফুলকে (৭৭) রাজধানীর উত্তরা-পশ্চিম থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) একটি দল। তিনি পরিচয় দিতেন উপসচিব হিসাবে।’
চক্রটি আসলে টার্গেট করে ফাঁদ পেতে প্রতারণা করত জানিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এ চক্রের সম্পর্কে জানা যায় ২০২৩ সালে। তবে তারা ২০১৯ সাল থেকে এ ধরনের অভিনব প্রতারণায় জড়িত। এমপিওভুক্তি বাতিল করার ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং এমপিওভুক্তি বহাল রাখা, আবার মাদ্রাসার নবনিযুক্ত লাইব্রেরিয়ানদের বেতন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শাখা থেকে নিয়মিত করে দেওয়ার কথা বলে আসাদুজ্জামান মানিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও সুপারদের সাক্ষাৎ করতে ঢাকায় ডাকা হয়।
আরও পড়ুন: ‘টাকা ছাড়া এমপিও হয় না’—মতিঝিল মডেল কর্তৃপক্ষের অডিও ফাঁস
‘এরপর ২০২১ সালের ২ আগস্ট উল্লেখিত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও সুপাররা বিশ্বাস করে সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিপরীতে ওসমানী মিলনায়তনের সামনে দেখা করেন জোবায়ের রহমানের সঙ্গে। যিনি নিজেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শাখার প্রোগ্রাম অফিসার পরিচয় দেন। সেখান থেকে মামলার বাদী ভোলা চরফ্যাশনের কুচিয়ামোড়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল কামরুজ্জামানসহ অন্য সব মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও সুপাররা বংশাল থানা রায়সাহেব বাজারে যান। সেখানে ১২ লাখ টাকা চান জোবায়ের। সেদিন নগদ দেওয়া হয় ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা। চারটি মোবাইল ফোন নম্বরে নগদ ও বিকাশের মাধ্যমে আরও মোট ৪ লাখ ৬১ হাজার ১০০ টাকা পাঠান শিক্ষকরা।’
জাহাঙ্গীর আলম আরও জানান, টাকা দিয়েও কাজ না হওয়ায় এবং মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন বন্ধ হয়ে যায় এবং নিয়োগপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ানদের বেতনের অগ্রগতি না দেখতে পেয়ে সবাই খোঁজ নিতে থাকেন। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে খোঁজখবর নিয়ে তারা জানতে পারেন, জুবায়ের ওরফে আসাদুজ্জামান মানিক নামে কোনো প্রোগ্রাম অফিসার কর্মরত নেই। তখন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা নিরুপায় হয়ে একরকম রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলেন। টাকা ফেরত পাচ্ছিলেন না। পিবিআই মামলাটি তদন্তের ভার নিয়ে দুই মাসের মধ্যেই মূল দুই প্রতারককে গ্রেফতার করে।
ভুক্তভোগীদের একজন বরগুনা সদরের পূর্ব হাজারের একটি মাদরাসার অধ্যক্ষ। তিনি তার প্রতিষ্ঠানের ছয় শিক্ষকের জন্য ১৪ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষকদের আবেদনের কিছুদিন পর উপসচিব পরিচয়ে একজন কল করে টাকা দাবি করে। আমরা ছয়জনের জন্য ১৪ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। পরে বুঝতে পারি প্রতারিত হয়েছি। টাকা দেওয়ার কারণ হিসেবে বলেন, শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হতে পারলে তাদের বেতন-ভাতা বাড়বে। এ আশা থেকেই টাকা দেওয়া।
আরও পড়ুন: ৪০৬ কোটি ব্যয়ে সোয়া ৪ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেবে মাউশি
প্রতারণার শিকার একজন ২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বংশাল থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে পিবিআই। তদন্তে পাওয়া তথ্য ও প্রতারিতদের অভিযোগের ভিত্তিতে জুবায়ের ওরফে মো. আসাদুজ্জামান মানিক ওরফে লুৎফর রহমানকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের ফলগাছা গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অন্য সহযোগী আব্দুল গফফার ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে সাইফুলকে রাজধানীর উত্তরা-পশ্চিম থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) একটি দল।
পিবিআই জানিয়েছে, বরগুনার পূর্ব হাজার বটতলা সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৩ লাখ ৭০ হাজার, নাটোরের বাগাতিপাড়া টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে ৮৫ হাজার, ভোলার উত্তর চরমানিকা লতিফীয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে ১১ লাখ ৬০ হাজার, জয়পুরহাটের মোহাব্বতপুর আমিনিয়া ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়েছে প্রতারকরা। এ চারটি প্রতিষ্ঠানসহ অন্য মাদ্রাসা শিক্ষকদের কাছ থেকে আরও ৪ কোটি ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৭২ টাকা আত্মসাতের কথা স্বীকার করেছে দুই প্রতারক।