৫ লাখ শিক্ষকের বোবা কান্না দেখার কেউ নেই
তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে সহকারী শিক্ষক পদে যশোরের একটি স্কুলে নিয়োগ পেয়েছেন দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার তসলিম উদ্দিন। স্ত্রী-সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে রেখেই প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে চাকরিটি করছেন। একদিকে দিনের পর দিন পরিবার থেকে দূরে থাকা, অন্যদিকে দূরত্ব— স্বভাবতই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন তসলিম।
গতকাল রবিবার বদলির বিষয়ে খোঁজ নিতে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) কার্যালয়ে এসেছিলেন তসলিম। সেখানেই দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে জানান, ‘মাত্র ১২ হাজার ৭৫০ টাকা বেতনে চাকরি করি। এ টাকা দিয়ে নিজের চলাই কষ্টসাধ্য। পরিবারকে কি পাঠাবো? চাকরি করি কিন্তু ছেলে-মেয়ের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি না। চাকরি করেই যেন অসহায় হয়ে গেছি। ছেলে-মেয়েদের ঠিকমতো পাশে দাঁড়াতে পারি না। মা-বাবার কাছেও ছোট হয়ে গেছি। নিজ জেলাতে চাকরি করলে এই কষ্ট কিছুটা লাঘব হত। তবে বদলির ব্যবস্থা না থাকায় নিজ জেলায় যাবার স্বপ্ন আর পূরণ হচ্ছে না। যে বেতন পাই তা দিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবো সেই সুযোগও নেই।'
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, গণবিজ্ঞপ্তিতে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হলে নতুনরা চাকরির সুযোগ পান না। অনেক জায়গায় শিক্ষক সংকট লেগে থাকে। এই অবস্থায় এনটিআরসিএ’র সুপারিশে মন্ত্রণালয় ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ রহিত করে।
শুধু তসলিম উদ্দিন নয়; বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষকের অবস্থা একই। বদলির ব্যবস্থা না থাকায় নিজ বাড়ি থেকে শত শত কিলোমিটার দূরের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে হচ্ছে তাদের। জাতি গড়ার কারিগররা নীরবে কেঁদে যাচ্ছেন। তবে তাদের সেই বোবা কান্না দেখার কেউ নেই।
জানা গেছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করে এনটিআরসিএ। এখন পর্যন্ত চারটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অসংখ্য শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষকদের বদলির ব্যবস্থা না থাকলেও গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের মাধ্যমে নিজ জেলায় যাওয়ার সুযোগ ছিল। প্রথম থেকে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষকদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হলেও চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আবেদনের সুযোগ রহিত করা হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষকরা।
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলছেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল-কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ এ বলা হয়েছে, এনটিআরসিএ এর সুপারিশে নিয়োগ পাওয়া এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শিক্ষক/প্রদর্শক/প্রভাষকদের কোনো প্রতিষ্ঠান শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষে সমপদে ও সম স্কেলে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা প্রণয়ন করে জনস্বার্থে আদেশ জারি করতে পারবে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনও এটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
প্রতিদিন অসংখ্য শিক্ষক আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। বদলির বিষয়ে জানতে চান। তবে আমরা তাদের কোনো সুখবর দিতে পারি না। শিক্ষকদের বদলির ফাইল হাত দিলেই নানা জটিলতা দেখা দেয়। শিক্ষকদের পারস্পারিক বদলি কিংবা অন্য কোনো উপায়ে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করা যায় কি না সে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনা অনেকদিন ধরেই হচ্ছে—এনটিআরসিএ কর্মকর্তা
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, গণবিজ্ঞপ্তিতে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হলে নতুনরা চাকরির সুযোগ পান না। অনেক জায়গায় শিক্ষক সংকট লেগে থাকে। এই অবস্থায় এনটিআরসিএ’র সুপারিশে মন্ত্রণালয় ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ রহিত করে।
এনটিআরসিসএ’র একটি সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। এই তথ্যের উপর ভিত্তি শিক্ষকদের বদলি কার্যক্রম পরিচালনা করতে চান তারা। বিষয়টি লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। তবে তাদের পাঠানো প্রস্তাবনা এখনো অনুমোদন হয়নি। এই অবস্থায় শিক্ষকদের সমস্যার সমাধান কবে হবে সে বিষয়ে তারাও কিছু বলতে পারছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিআরসিএ’র এক কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রতিদিন অসংখ্য শিক্ষক আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। বদলির বিষয়ে জানতে চান। তবে আমরা তাদের কোনো সুখবর দিতে পারি না। শিক্ষকদের বদলির ফাইল হাত দিলেই নানা জটিলতা দেখা দেয়। শিক্ষকদের পারস্পারিক বদলি কিংবা অন্য কোনো উপায়ে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করা যায় কি না সে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনা অনেকদিন ধরেই হচ্ছে।
বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে এনটিআরসিএ আমাদের যে প্রস্তাবনা দিয়েছে তা অনেকগুলো কারণে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বতন্ত্র, আলাদা ধরণ ও মানের পরিবর্তন থাকায় এনটিআরসিএ’র প্রস্তাবনা নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েও সুফল আসেনি। এ ছাড়াও পরিচালনা কমিটি আলাদা শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে ভিন্নতা, বেতনভাতা ও পদোন্নতি নিয়েও আলোচনার টেবিলে জটিলতা দেখা দেয়। এসব কারণে শিক্ষকদের প্রাণের দাবি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না—শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিআরসিএ’র সচিব মো. ওবায়দুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষকদের গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন সুযোগ বন্ধ করেছে মন্ত্রণালয়। তবে আমরা তাদের বদলির বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। তবে বিষয়টি নির্ভর করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নানা কারণে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে অন্যতম হলো- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের বিষয়টি। কেননা সব প্রতিষ্ঠানের স্ট্যাকচারাল এলিমেন্ট ভিন্ন তাই এই বদলি নিয়ে এগুনো মুশকিল। এছাড়া বদলি শুরু হলে দেখা যাবে হাওর বা দুর্গম এলাকার শিক্ষকরা সেখানে চাকরি করতে চাইবেন না। এসব কারণে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে এনটিআরসিএ আমাদের যে প্রস্তাবনা দিয়েছে তা অনেকগুলো কারণে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বতন্ত্র, আলাদা ধরণ ও মানের পরিবর্তন থাকায় এনটিআরসিএ’র প্রস্তাবনা নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েও সুফল আসেনি। এ ছাড়াও পরিচালনা কমিটি আলাদা শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে ভিন্নতা, বেতনভাতা ও পদোন্নতি নিয়েও আলোচনার টেবিলে জটিলতা দেখা দেয়। এসব কারণে শিক্ষকদের প্রাণের দাবি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) আবদুন নূর মুহম্মদ আল ফিরোজ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নিয়ে কাজ চলছে। এ বিষয়ে এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।