ছিন্নমূল শিশুদের জন্য প্রথম স্কুল গড়েন ছফা ও মোস্তান
পথে পথে ঘোরে ওরা। ঘুমায় পথের পাশে। খাবার-জীবিকার খোঁজে এ দরজা থেকে সে দরজা। আর আট দশটা শিশুদের মত ওদের আশ্রয় নেই। নেই স্বজন। ওরা টোকাই। পথশিশু। ছিন্নমূল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর এসব শিশুদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন লেখক ঔপন্যাসিক চিন্তাবিদ আহমদ ছফা এবং সাংবাদিক নাজিম উদ্দীন মোস্তান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এ দুই শিক্ষার্থীর হাত ধরেই যাত্রা শুরু করে ক্যাম্পাস ও এর চারপাশের ছিন্নমূল শিশুদের জন্য প্রথম অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা।
বাংলাদেশ স্বাধীনে নেতৃত্ব দেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশ পুর্নগঠন-পুর্নবাসনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। কিন্তু স্বাধীনতার ১০ বছর পরও ছিন্নমূল শিশুদের শিক্ষা নিয়ে তেমন উদ্যোগ ছিল না। বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে গণবুদ্ধিজীবি ছফাকে। ১৯৮২ সালের দিকে লেখক আনতােন মাকারেঙ্কোর বই ‘রোড টু লাইফ’ পড়েন আহমদ ছফা। সেটি তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের তখনকার সিনিয়র রিপোর্টার নাজিম উদ্দীন মােস্তানকেও পড়তে দেন। এ বই পড়ার পর তারা ছিন্নমূল শিশুদের পড়াশোনার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে যেখানে বঙ্গবন্ধু, জিয়া এবং বিজয় একাত্তর হল সেখানে একসময় বস্তি ছিল। এই বস্তির একটি অংশে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা।
আহমদ ছফা লিখিত ‘অনানুষ্ঠানিক শিশু শিক্ষা প্রসঙ্গে’ নিবন্ধ পাঠে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমসাময়িক কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষকের সঙ্গে বক্তব্যে এ তথ্য পাওয়া যায়। নিবন্ধটি ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ‘সংকটের নানান চেহারা’ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়। এটি প্রকাশ করে বাডস পাবলিকেশন্স।
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের মতই দেশ পুনগর্ঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা নানাভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। এরশাদ সরকারের শুরুর দিকে স্কুলটি চালু হয়েছিল। এটি ক্যাম্পাসে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। তবে সেটি বেশিদিন টেকেনি। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গণে এমন স্কুল বা পড়াশোনার ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামে এবং নাজিম উদ্দীন মোস্তান ১৯৪৮ সালে চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্র এবং কর্মজীবনে তারা নিজ পেশার বাইরেও অনেক সামাজিক কাজে উদ্যোগী হয়েছিলেন এবং অংশগ্রহণ করেছিলেন।
স্কুলটি প্রতিষ্ঠার গোড়ার অনুপ্রেরণা এবং তথ্য সম্পর্কে আহমদ ছফা লেখেন, “মাকারেংকো সাহেব ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর ছিন্নমূল শিশু কিশোর এবং বিপথগামী যুবকদের শিক্ষা দেয়ার যে বিশেষ পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেছিলেন, এই বইটিতে তার নানামুখী অভিজ্ঞতার কথা বয়ান করেছিলেন। লেখাটি পাঠ করার পর আমি অত্যন্ত চঞ্চল এবং উতলা হয়ে উঠি। আমার মনে হতে থাকে যে, আমার চারপাশে যে হাজারে হাজারে অবহেলিত শিশুরা রয়েছে তাদের প্রতি কোন কর্তব্য আমি করিনি। একটি অপরাধবােধ আমার মনে পাথরের মত চেপে থাকে। এই ‘Road to Life’ বইটি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সিনিয়র রিপাের্টার জনাব নাজিম উদ্দীন মােস্তানকেও পড়তে দেই। তিনিও বইটি পাঠ করার পর আমার মত উদ্দীপিত বােধ করেন এবং আমরা দুজনে মিলে অনেক আলােচনার পর ঠিক করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে নীলক্ষেতের বস্তিতে শিশুদের একটি স্কুল তৈরি করে মাকারেংকোর কিছু আইডিয়া কাজে খাটাতে চেষ্টা করব। এখানে বলে রাখা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, শাহবাগের দক্ষিণে বর্তমানে যেখানে বঙ্গবন্ধু এবং শহীদ জিয়া ছাত্রাবাস দুটি তৈরি হয়েছে সেই জায়গাটি ছিল খালি এবং কাটাবন মসজিদটিও ছিল একেবারে ক্ষুদ্র। এই প্রশস্ত খালি জায়গাটিতে বসানাে হয়েছিল হাজার হাজার ঝুপরিঘর। আমরা এই বস্তিতে একটা ফাকা জায়গা বেছে নিয়ে একটি স্কুলঘর করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং বস্তির লােকজনের একাংশকে রাজি করালাম, আমরা যদি স্কুলটি চালু করি, তারা যেন তাদের ছেলে-মেয়েদের পাঠাতে অমত না করেন।”
স্কুলটি পরিচালনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আহমদ ছফা বলেন, “আমরা ছেলে-মেয়েদের যখন পড়াতে শুরু করলাম, আমাদের একটা কঠিন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হল। বস্তির এই শিশুদের মুখ থেকে অনর্গল অশ্লীল বুলি নির্গত হয়। একজন আরেকজনের মা-বাবা তুলে এমন অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে যে, শুনলে কানে হাত দিতে হয়। একজন শিশুকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘তােমার বাবা কি করেন?’ পাশের শিশুটি জবাব দেবে, ‘অর বাপ ছিচকা চোর।’ একটা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তােমার মা কি কাজ করেন?’ তার বয়েসী পাশের মেয়েটি কালবিলম্ব না করেই জবাব দিয়েছিল, ‘অর মা খারাপ কাম করে।’ এই জাতীয় বাচনরীতির সঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম না। তথাপি কি করব! বাচ্চাদের স্কুলটি যখন আরম্ভ করেছি, ফেলে দিয়ে তাে আর আসতে পারিনে।”
আরো পড়ুন: আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যরা
স্কুলটি চালুর ব্যাপারে আহমদ ছফার বেশি উদ্যোগ থাকলেও পরিচালনায় বেশি অংশগ্রহণ ছিল সাংবাদিক নাজিম উদ্দীন মোস্তানের। এ প্রসঙ্গে ছফা উল্লেখ করেন, “স্কুল চালানোর ব্যাপারে আমার কোন কৃতিত্ব ছিল না। সিলেবাস তৈরি, শিক্ষকতার কাজ সবকিছু একা মাস্তান ভাই করতেন। তাঁকে রেজা নামের একটি যুবক সাহায্য করত। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, এই সুন্দর যুবকটি অকালে মারা যায়। নাজিম উদ্দীন মোস্তান সাহেবের মত এরকম নিষ্ঠাবান শিশুদের দরদি মানুষ আমি জীবনে দুটি দেখিনি।”
ওই রচনায় ছফা বলেন, “সব মিলিয়ে স্কুলটি আমরা সাত আট মাসের বেশি চালাতে পারিনি। এরশাদ সাহেব সবে ক্ষমতায় এসেছেন। তার লােকেরা মনে করলেন আমাদের বিশেষ রাজনৈতিক অভিসন্ধি রয়েছে। নইলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমরা স্কুলটি চালাবার ঝুঁকি নেব কেন! জেনারেল আবদুর রহমান উদ্যোগ নিয়ে আমাদের পাশে আরেকটি স্কুল বানালেন। স্কুলে হাজিরা দিলেই শিশুদের মাথাপিছু আধাকেজি করে চাল দেবার ব্যবস্থা করলেন। আমাদের স্কুলটি উঠিয়ে দিতে হল। অবশ্য জেনারেল আবদুর রহমান কর্তৃক পাল্টা স্কুল করাই তার একমাত্র কারণ নয়। স্কুলটি বড়জোর সাত আট মাস চালু রাখতে পেরেছিলাম। এই সময়টাতেই আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিনগুলাে কাটিয়েছি। শিশুদের শিক্ষা দিয়ে যে নির্মল আনন্দ পাওয়া যায় তার স্বাদ এত মধুর হতে পারে আগে কল্পনাও করতে পারিনি। এই স্কুল চালাতে গিয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেগুলাে আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ মনে করি।”
জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের পর ত্রাণ ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষাখাতে বড় আকারে কাজ শুরু করে ব্র্যাক। বিভিন্ন জেলায় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় তারা অবদান রাখতে শুরু করে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা তার আশপাশে এমন উদ্যোগ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়েল বাতির নিচের সেই অন্ধকার দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন আহমদ ছফা ও নাজিম উদ্দীন মোস্তান। এরপরও স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরও এ বিশ্ববিদ্যালয় ও এর চারপাশে ছিন্নমূল শিশুদের দেখা যায়। আশার কথা, এদের অনেকের আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে।