সুখবরের আশায় সাধারণ মানুষ

সুখবরের আশায় সাধারণ মানুষ
সুখবরের আশায় সাধারণ মানুষ

জুলাই মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে। বেড়েছে রেমিট্যান্সও। এছাড়া আমদানির প্রবণতাও কমেছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালনি তেলের দাম যেমন কমছে তেমন ভোগ্যপণ্যের দামও কমছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব এখনো সামান্যই।

চালের বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য চাল আমদানি বাড়াতে সরকার উদ্যোগ নিলেও তার প্রভাব নেই বাজারে। চালের আমদানি শুল্ক ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। গত জুন থেকে এর্পন্ত ৩৮০টি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে নয় লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। যদিও দেশে পর্যাপ্ত চাল মজুত আছে। বর্তমানে মজুত চালের পরিমান ১৪ লাখ টনের বেশি। 

এরপরও চালের দাম না কমে উল্টো বাড়ছে। মোটা চালের দাম কেজিতে তিন টাকা বেড়ে ৫৬ টাকা হয়েছে। আর নাজিরশাইল কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়ে হয়েছে ৮৫-৯০ টাকা। অন্য চালের দামও গত এক সপ্তাহে কেজিতে দুই থেকে চার টাকা বেড়েছে।

বিশ্ব বাজারে ভোজ্য তেলের দাম কমেছে। সয়াবিনের চেয়ে পাম অয়েলের দাম কমেছে বেশি। ভোজ্য তেলের দাম গত দুই মাসে টনপ্রতি ৪০০ থেকে ৫৫০ ডলার কমেছে। দুই সপ্তাহ আগে দেশের বাজারে তাই সয়াবিন তেলের দাম কমিয়ে সরকার ১৮৫ টাকা লিটার নির্ধারণ করে দিলেও সয়াবিন তেল ১৯০-১৯৫ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে। দেশে ভোজ্য তেলের কোনো ঘাটতি নেই। বছরে ৩০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে গত চার মাসে আমদানি করা হয়েছে আট লাখ টন। 

কলাবাগানের দোকানদার আবদুর রহিম জানান, ‘‘বোতলের গায়ে ১৮৫ টাকা লেখা থাকলেও আমরা ১৯০-১৯৫ টাকা নিচ্ছি। কারণ আমাদের ওই দামে পোষায় না। আর চালের দাম কমেনি বরং বাড়তির দিকে।”

এদিকে বোতলের গায়ে ১৮৫ টাকা লিটার লিখে বাজারে তেল সরবরাহ করতে ব্যবসায়ীরা ১০ দিনেরও বেশি সময় নিয়েছে। এখনও অনেক দোকানে ১৮৫ টাকা লিটার লেখা তেল পাওয়া যাচ্ছে না। অভিযোগ আছে এই কৌশলে পাঁচটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এই সময়ে বাড়তি ১৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

এর বাইরে আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের মধ্যে বিশ্ববাজারে মশুরের ডাল, গম, চিনি ও চালের দামও কমেছে। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের হিসেবে বিশ্ববাজারে মে মাসের তুলনায় জুলাই এ গমের দাম কমেছে৩১ শতাংশ, চাল ১২ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৩১ শতাংশ, পাম অয়েল ৩৬ শতাংশ, চিনি ৬ শতাংশ, মশুরের ডাল ১৯ শতাংশ, গুঁড়া দুধ  ৬ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে এর তেমন কোনো প্রভাব নেই।

আরও পড়ুন: টোল আদায়ে বঙ্গবন্ধু সেতুকে ছাড়াল পদ্মা

কনজ্যুমারস অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম যে অনুপাতে কমেছে বাংলাদেশে সরকার সেই অনুপাতে কমায়নি। তারপরও সরকার যেটা কমিয়েছে ব্যবসায়ীরা সেটা মানছে না। চালের বাজারেও সিন্ডিকেট। আসলে সরকার ব্যবসায়ীদের সাথে পারছে না। এর কারণ এই ব্যবসায়ীরাই সরকারে আছে, সংসদে আছে। তারাই মন্ত্রী-এমপি। সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। আবার দোকানে দোকানে তো অভিযান চালানো সম্ভব না।”

তার কথা, ‘‘ব্যবসায়ীদের মধ্যে নৈতিকতা না থাকায় এই পরিস্থিতি। তারা সব সময়ই অতি মুনাফা করতে চায়।”

এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও কমছে। গত মার্চে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১৩৯ ডলার পর্যন্ত ওঠে। এখন সেই জ্বালানি তেলের দাম ৯৭ ডলার। কিন্তু বাংলাদেশে এর প্রভাব নেই। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশেও বাড়ে। আর তার প্রভাব পড়ে গণপরিবহনের ভাড়া থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের বাজারে।

কিন্তু বিশ্ববাজারে কমলে বাংলাদেশে কখনোই কমে না। একটিই অজুহাত বিপিসির লোকসান। অথচ কম দামের জ্বালানি তেল বেশি দামে বিক্রি করে বিপিসি ২০১৪-১৫ অর্থ বছর থেকে ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৪৮ হাজার ১২২ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে।

ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি শুরু হওয়ার হওয়ার কারণে বিশ্ব বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম আরো কমবে। খাদ্যশস্য রপ্তানির দিক দিয়ে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে আছে দেশটি। যুদ্ধ শুরুর পর দেশটি থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ ছিলো।

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সদস্য শাহ মো. আবু রায়হান আলবেরুনী বলেন, "বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কমতির দিকে। আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে এটা আরো কমবে। ভোজ্য তেলের দামও আরো কমবে। বাংলাদেশে আবারো সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম কমানো হবে। বিশ্ববাজারের দাম কমার পর এখানে যখন সরকার কমায় তখন ভোজ্য তেল আমাদিকারকেরা নানা প্রক্রিয়ার অজুহাত দেখিয়ে কমাতে সময় নেয়। এই ফাঁকে তারা বাড়তি ব্যবসা করে নেয়। কিন্তু বাড়লে তারা রাতারাতি বাড়িয়ে ফেলে। এর বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।”

রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ছে, এলসি কমছে

জুলাই মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে। অর্থ বছরের প্রথম মাসে  রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৯৮ কোটি ২৮ লাখ ২০ হাজার ডলার। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪.৭২ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১.৬৫ শতাংশ বেশি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)  এই হিসাব দিয়েছে।

তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকে রপ্তানি আয়ে  এক মাসে ১৬. ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। নিট ও ওভেন মিলিয়ে ৩৩৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে জুলাইয়ে। তবে পোশাক রপ্তানিকারকেরা বলছেন রপ্তানি আয় বাড়লেও সার্বিকভাবে অর্ডার কমছে। যার প্রভাব হয়তো সামনে দেখা যাবে।

জুলাই মাসে আমদানির প্রবণতা কমেছে। ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমার কথা। জুলাই মাসে আগের মাসের তুলনায় শতকরা ৩১ ভাগ আমদানি ঋণপত্র (এলসি) কম খোলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে জুলাই মাসে দেশে মোট এলসি খোলা হয়েছে ৫৪৭ কোটি ডলারের পণ্যের। এটা জুন মাসের তুলনায় ৩১.৩২ শতাংশ কম। জুন মাসে আমদানি এলসি হয়েছিল ৭৯৬ কোটি ডলারের। তবে জুন মাসে মে মাসের তুলনায় এলসি ৭ শতাংশ বেশি খোলা হয়েছিল।

রেমিট্যান্সও জুলাই মাসে বেড়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে জুলাই মাসে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। যা গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২০ সালের মে মাসে ২১৭ কোটি ২০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিলো।

২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দুই হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ  ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। যা ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ১৫.১১ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, "প্রবাসী আয়ের ব্যাপারে আরো কয়েক মাস দেখতে হবে যে ধারাটি অব্যাহত থাকে কী না। কারণ কোরবানিকে সমানে রেখে প্রবাসীরা সব সময়ই দেশে ডলার বেশি পাঠান। আত্মীয়-স্বজনের কোরবানি ছাড়াও তারা হজের জন্যও টাকা পাঠান। তার প্রতিফলনই জুলাই মানের রেমিট্যান্সে দেখা গেছে।”

রপ্তানি আয় বাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন,"পোশাক খাতে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি তো ৩৪ ভাগ ছিলো। এখন  প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ ভাগ। সুতরাং প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে গেছে। আবার ঈদের মাসে রপ্তানি বেশি হয়। কারণ অর্থের প্রয়োজন বেশি হয়। তারপরও ভালো যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এটা ধরে রাখতে হবে। তবে বিশ্ববাজারের পণ্যের দাম কমছে। তুলার দামও কমছে। আগামীতে  তাই তৈরি পোশাকের দামও কমবে। ফলে তৈরি পোশাকের মাধ্যমে রপ্তানি আয় বাড়াতে হলে অর্ডার বাড়াতে হবে।”

আমদানি কমান প্রবণতাকে এখনো তিনি পর্যবেক্ষণ করতে চান। তার কথা,"ঈদের মাসে স্বাভাবিকভাবেই এলসি কম খোলা হয়। কারণ ১০-১২দিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।”

তিনি মনে করেন, সরকার যে সাশ্রয়নীতি গ্রহণ করেছে এটা অব্যাহত রাখতে হবে। এর প্রভাব বুঝতে সবদিক দিয়েই আরো সময় লাগবে। কারণ এটা এখন অনেকটা মানসিক। বাস্তবতা বুঝতে কয়েক মাস লাগবে।

মূল্যস্ফীতি কমেছে

এদিকে জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৭.৪৮ শতাংশ হয়েছে। যা গত জুন মাসে ছিল ৭.৫৬ শতাংশ। জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছ ৮.১৯ শতাংশ। যা গত জুন মাসে ছিল ৮.৩৭ শতাংশ। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বুধবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘‘নিত্য পণ্যের দাম কিছুটা কমে আসায় মূল্যস্ফীতি কমছে। আশা করি এটা আরো কমবে।” [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]