শখে বানানো হেয়ার ব্যান্ডে ভাগ্য বদল ডিগ্রির ছাত্রী আশিকার

আশিকা জাহান
নিজের তৈরি পণ্য দেখাচ্ছেন আশিকা জাহান

চাকরি নয়, ভিন্ন কিছু করতে হবে। এমন চিন্তা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন প্রত্যন্ত এলাকার মেয়ে আশিকা জাহান। শখের বশে বানানো হেয়ার ব্যান্ড বদলে দিয়েছে ভাগ্য। মাত্র এক হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে অনলাইনে কাজ শুরু করে সৃষ্টি করেছেন ‘আশিকাস টুইস্ট’ নামে নিজস্ব ব্রান্ড। 

সময়ের স্রোতে গা না ভাসিয়ে নিজস্ব পরিচয় তৈরি করতে উদ্যােগ নিয়েছেন আশিকা। পটুয়াখালী জেলার গলাচিপায় ২০০১ সালে জন্ম তার। পিতার নাম মো. জয়নাল খলিফা এবং মাতা হোসনেয়ারা বেগম। এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট আশিকা। ২০১৭ সালে এসএসসি ও ২০১৯ সালে এইচএসসি পাস করে বর্তমানে তিনি ডিগ্রি (বিএ) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি যুক্ত রয়েছেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অধিনে কিশোর কিশোরী ক্লাবের একজন আবৃত্তি শিক্ষক তিনি।

উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ কিভাবে তৈরি হলো— জানতে চাইলে আশিকা জানান, শুরুটা জুন ২০২১ করোনাকালে। সবাই যেমন লকডাউনে ঘরে বসে আয়ের পথ খুঁজতেন, তেমনি তিনিও কিছু একটা করার চিন্তা করছিলেন। সুযোগ পেলেই ইন্টারনেট ইউটিউব, ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। অনলাইনে কাজ দেখে শিখতেন। হটাৎ একদিন নিজের  ইচ্ছে থেকে ভাগ্নীকে জন্মদিনে উপহার দেয়ার জন্য শখের বশে নিজ হাতে তৈরি করলেন কাপড় দিয়ে তৈরি হেয়ার ব্যান্ড। এই উপহার পেয়ে ভাগ্নী বেশ পছন্দ করেছিলেন সেদিন। পরবর্তীতে বান্ধবীদের অনুপ্রেরণা ও নিজের অদম্য ইচ্ছে থেকেই ব্যবসা শুরু করা।

কাজের শুরুটা কিভাবে হয়েছিল এমন প্রশ্নে তিনি জানান, সেলাই মেশিন চালানোর প্রশিক্ষণ থাকায় এ ধরনের কাজ খুঁজতেন। তাই হাত খরচের টাকা জমিয়ে এক হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে কাপড় কিনে বাসায় থাকা মেশিনের সাহায্যে প্রথমে কাপড়ের হেয়ার ব্যান্ড তৈরি শুরু করেন। ফেইসবুকে ‘আশিকাস টুইস্ট’ (Asika's Twist) নামে পেজ খুলে দেড় হাজার টাকার হেয়ার ব্যান্ড বিক্রির মধ্যে দিয়েই পথচলা শুরু।

আরো পড়ুন: অ্যামাজনে চাকরি পেলেন খাইরুল্লাহ

পরে ক্রেতার ভালো সাড়া পেলে একপ্রকার ঝুঁকি নিয়ে লাভের টাকা দিয়ে নতুন নতুন প্রডাক্ট যুক্ত করেছেন ব্যবসায়। এখন শুধু হেয়ার ব্যান্ড ও কাস্টমাইজড আইটেমই নয়, যুক্ত হয়েছে মেটালের তৈরি নানা ধরনের গহনা। অবসরে নতুন নতুন রান্না করতে পছন্দ করা আশিকার এক সময় ইচ্ছে ছিল রান্না নিয়ে কিছু একটা করার। তবে মানুষের মুখের স্বাদ বোঝা কঠিন বলে করা হয়নি। 

তবে ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে তেমন কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি বলে জানান তিনি। আশিকা বলেন, মায়ের  অবদান-সাপোর্ট ছিলো সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি রয়েছে বন্ধু-বান্ধবী, শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতা। এ ছাড়া ফেসবুকভিত্তিক দুটি গ্রুপ তার পণ্যের পরিচিতি বাড়াতে ও পণ্য ডেলিভারিতে অবদান রেখেছে অনেক।

তবে অনলাইনে ক্রেতা ধরে রাখা কঠিন কাজ। মাঝে মধ্যে পণ্য ডেলিভারি নিয়ে একটু ঝামেলা হলেও প্রতিনিয়ত নতুন ক্রেতা যুক্ত হচ্ছে। দিনে দিনে এ তালিকা বেশ লম্বা হয়েছে। প্রতি মাসে ৩৫ থেকে ৪০ জনকে পণ্য ডেলিভারি করেন। এর থেকে মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকা সেল হয় বলে জানান তিনি। 

প্রতিযোগিতার বাজারে তার পণ্য মানুষ কেন পছন্দ করবে এমন প্রশ্নে আশিকা বলেন, প্রতিটি পণ্য তার নিজ হাতের তৈরি। ফলে চাইলেই মনের মতো করে পছন্দের গহনা ডিজাইন করে দেয়া যায়, মানে কাস্টোমাইজড করা যায় যেটা দোকান থেকে কিনলে পারবে না। তার কাছে ৩০ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকার গহনাও পাওয়া যায়। প্রতিটির দাম খুবই রিজেনেবল। এ ছাড়া বাজারে রেডিমেড পণ্যের থেকে তার কাছে কম দামে ক্রেতা ভালো মানের ও ডিজাইনের পণ্য পাবে, তাই  কিনবে বলে মনে করেন তিনি। 

প্রতি মাসে তার আয় কেমন জানতে চাইলে বলেন, অনলাইনে প্রতিদিন সেল হয় না, কখনো কম কখনো বেশি হয়। প্রতি মাসে সমান সেল হয় না। কোন মাসে ২ হাজার কোন মাসে ৫ হাজার আবার কোন মাসে ৭-৮ হাজার। মাসিক নির্দিষ্ট কোন আয় নেই। যত বেশি অনলাইনে সময় ও পরিশ্রম ব্যয় করবে তত বেশি সেল ও আয় হবে।

নিজের ব্যবসা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আশিকা জাহান বলেন, হ্যান্ডমেইড মেটেরিয়াল জুয়েলারি আর ফেব্রিকের হেয়ার ব্যান্ড নিয়ে আমার কাজ। জুয়েলারি গুলোর মেটেরিয়ালস কিনে তারপর আমি নিজ হাতে ডিজাইন করে তৈরি করি। কাপড়ের তৈরি চুলের ব্যান্ডগুলো আমার বানানো সেলাই মেশিনের সাহায্যে। সবার থেকে আলাদা কিছু করতে চাওয়ার সেই চিন্তা থেকেই এগুলোর উদ্ভব। সব সময় চাই নিজের পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করতে। মানুষ আমাকে চিনবে আমার কাজ সম্পর্কে জানবে, নিজের কাজের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করতে চাই।

তিনি আরও বলেন, গলাচিপা পৌরসভার বর্তমান মেয়র তুহিন খলিফা আমার আপন চাচাতো ভাই এবং উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ওয়ানা মার্জিয়া নিতু চাচাতো বোন। তাদের যেমন নিজস্ব পরিচিতি আছে, আমিও তেমন আমার নিজেস্ব একটি পরিচিতি তৈরি করতে চাই কাজের মাধ্যমে। একজন সফল উদ্যোক্তা হতে চাই। চাকরি করতে নয়, চাকুরি দিতে চাই মানুষকে। এ ছাড়া সফল উদ্যোক্তার অ্যাওয়ার্ড পেতে চাই।

আরো পড়ুন: একসঙ্গে পুলিশে চাকরি পেলেন দুই যমজ বোন

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে এই উদ্যােক্তা বলেন, স্বপ্ন অনেক বড় হওয়ার, গলাচিপায় নিজ নামে একটি আউটলেট দিতে চাই। অনলাইনে থেকে অফলাইনে সর্বক্ষেত্রে ব্যবসার পরিচিতি সারা বাংলাদেশের সব জেলায় সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই । নিজস্ব ব্রান্ডের প্রতিষ্ঠান তৈরি করে চাকরি দিতে চান বেকার তরুণ তরুণীদের পাশে দাঁড়াতে চািই। তাই লাভ কম করে সল্প মূল্যে পণ্য বিক্রি করে কাস্টমারের মন জয় ও পরিচিতি লাভ করতে কাজ করছি। এ ছাড়া তার সফলতার পথ এখনো অনেক বাকি বলেও মনে করেন এই উদ্যােক্তা।

শিক্ষার্থী থেকে অনেকে নতুন ক্ষুদ্র উদ্যাক্তা হয়েছেন তাদের উদ্দেশ্য বলেন, সাফল্য পেতে অনেক পরিশ্রম করতে হবে তাই  ধৈর্য নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নিজের পরিকল্পনা ও স্বপ্নকে প্রাধান্য দিয়ে ঝুঁকি নিতে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সাহস রাখতে হবে। কারো কথা না শুনে নিজের মনের কথা শুনতে হবে। কারো দেখাদেখি বা অনুকরণ নয় নিজের সৃষ্টিশীল কিছু তৈরি করতে হবে।

যে কাজটি করতে উদ্যােগ নিবে সেটির পেছনে লেগে থাকলে সফলতা আসবে। যা আছে পুঁজি শুরু হোক তা দিয়েই, হোক না তা ছোট। নিজ দক্ষতা দিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। আশিকাস টুইস্টে বিভিন্ন ধরনের ও রঙের হ্যান্ডমেইড ফ্রেব্রিক হেয়ার ব্যান্ড, হ্যান্ডমেইড মেটাল গহনা- লং নেকপিস সেট, চোকার সেট, কানের দুল, হিজাব পিন, ব্রুজ, সিংঙ্গেল টিকলি, পায়েল, ব্রেসলেট, ফিংগার রিং, ডাবল ফিংগার রিং, খোঁপার কাটা, রিং ব্রেসলেট, এবং চাবির রিং সহ নানা ধরনের পণ্য রয়েছে।