ঈদের দিন কী করবেন, কী করবেন না

ঈদের দিন কী করবেন
ঈদের দিন কী করবেন, কী করবেন না

ইসলাম ধর্মের মানুষদের জন্য সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এক মাস সিয়াম সাধনার পর আগামী সোমবার অথবা মঙ্গলবার বাংলাদেশের মানুষ এই উৎসবে মেতে উঠবে। তবে ঈদের দিন কি করবেন আর কি করবেন না তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দে থাকেন। আজকের পর্বটি সাজানো হয়েছে ঈদে আমাদের করণীয় এবং বর্জনীয় বিষয়গুলো নিয়ে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও গোসল: ঈদের দিন গোসলের মধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা মোস্তাহাব। কেননা ঈদের দিনে সালাত আদায়ের জন্য মুসলমানরা এক জায়গায় মিলিত হন। মূলত যে কারণে জুমআর দিনে গোসল করা মোস্তাহাব সে কারণেই ঈদের দিন ঈদের নামাজের আগে গোসল করা মোস্তাহাব।

পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর পোশাক পরা: ঈদের দিনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর পোশাক পরিধান করা সুন্নত। হজরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত এ সংক্রান্ত একটি হাদিস আছে। তিনি বলেন, রাসূল (সা.)-এর একটি সুন্দর জুব্বা ছিল যা তিনি দুই ঈদে ও জুময়ার দিনে পরিধান করতেন। (মুসনাদ বায়হাকী)। ইবনে উমার (রা.) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত যে তিনি দু ঈদের দিনে সুন্দরতম পোশাক পরিধান করতেন। [ বায়হাকী : ১৯০১ ]

সুগন্ধি ব্যবহার করা: ঈদের দিন আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নত। এ দিন মুসলিমরা জামায়াতে মিলিত হন। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, তার প্রতি আল্লাহর যে নেয়ামত তা প্রকাশ ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করা। ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, ‘আমি ওলামাদের কাছ থেকে শুনেছি তারা প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার ও সাজ-সজ্জাকে মোস্তাহাব বলেছেন।’ (আল-মুগনি: ইবনে কুদামাহ)

ঈদের দিনে খাবার: ঈদুল আজহার দিন কিছু না খেয়ে ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়া এবং নামাজের পর কোরবানীর গোশত খাওয়া সুন্নত। তবে ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের নামাজ আদায়ের আগে হালকা খাবার গ্রহণ করা সুন্নত। হাদীসে বলা হয়েছে- বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না। সালাত থেকে ফিরে এসে কুরবানীর গোশত খেতেন। [ আহমদ : ১৪২২ ]

পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া: ঈদের দিনে ঈদগাহে তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিত। যাতে ইমামের নিকটবর্তী স্থানে বসা যায়। এছাড়া ভালো-কাজ তাড়াতাড়ি করার সওয়াব অর্জন করা যায়। একইসাথে সালাতের অপেক্ষায় থাকার সওয়াব পাওয়া যায়। ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া মোস্তাহাব। হাদীসে এসেছে—

হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীস- ‘সুন্নত হল ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া।’ ইমাম তিরমিযী হাদিসটি বর্ণনা করে বলেন হাদিসটি হাসান। তিনি আরো বলেন, অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এ অনুযায়ী আমল করেন। এবং তাদের মত হল পুরুষ ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাবে, এটা মোস্তাহাব। আর গ্রহণযোগ্য কোন কারণ ছাড়া যানবাহনে আরোহণ করবে না। [ তিরমিযী : ১৮৭ ]

এক পথে যাওয়া অন্য পথে ফেরা: ঈদগাহে যে পথে যাবে সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসা সুন্নত। জাবের (রা.) বর্ণিত হাদীস- ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন।’ [ বুখারী : ৯৩৩ ] অর্থাৎ যে পথে ঈদগাহে যেতেন সে পথে ফিরে না এসে অন্য পথে আসতেন।

নবী করিম (স.) কেন এমনটা করতেন সেবিষয়ে ইসলামী চিন্তাবিদরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অনেকে বলেছেন, ঈদের দিনে উভয় পথের লোকদেরকে সালাম দেয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য তিনি দু'টি পথ ব্যবহার করতেন। কেউ কেউ মনে করেন, ইসলাম ধর্মের শৌর্য-বীর্য প্রকাশ করার জন্য তিনি সকল পথে আসা-যাওয়া করতেন যেন সকল পথের অধিবাসীরা মুসলমানদের শান-শওকত প্রত্যক্ষ করতে পারে। আবার কেউ বলেছেন গাছ-পালা তরুলতা সহ মাটি যেন অধিক হারে মুসলমানদের পক্ষে সাক্ষী হতে পারে সে জন্য তিনি একাধিক পথ ব্যবহার করতেন।

ঈদের তাকবীর আদায়: হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। ঈদের সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। যখন সালাত শেষ হয়ে যেত তখন আর তাকবীর পাঠ করতেন না। আর কোন কোন বর্ণনায় ঈদুল আজহার ব্যাপারে একই কথা পাওয়া যায়। আরো প্রমাণিত আছে যে ইবনে উমার রা. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে ঈদগাহে আসা পর্যন্ত উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করতেন।

ঈদের সালাত: পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও কোরবানী কর।’ [সূরা কাউসার : ০২]

অধিকাংশ ইসলামিক পণ্ডিতের মতে, এ আয়াতে সালাত বলতে ঈদের সালাতকে বুঝানো হয়েছে। রাসূল (স.) সবসময় ঈদের সালাত আদায় করতেন। তিনি কখনও ঈদের সালাত পরিত্যাগ করেননি। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) বলেছেন, ‘ঈদের সালাত প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব। তবে ফরজ নয়।’ ঈদের সালাত যে ওয়াজিব এর আরেকটা প্রমাণ হল, যদি কোন সময় জুমআর দিনে (শুক্রবার) ঈদ হয় তখন সে দিন যারা ঈদের সালাত আদায় করেছে তারা সেদিন জুমআর সালাত আদায় না করলে গুনাহগার হবেন না। তবে ওই এলাকার ইমামের কর্তব্য হল, তিনি ঈদের দিনে জুমআর সালাতের ব্যবস্থা করবেন। যাদের আগ্রহ আছে তারা যাতে শরিক হতে পারে। মনে রাখতে হবে ঈদের দিন জুমআর সালাত পরিত্যাগ করার অনুমতি আছে। আর এ অনুমতির ভিত্তিতে কেউ জুমআর সালাত ত্যাগ করলে তার অবশ্যই জোহরের সালাত আদায় করতে হবে। তবে উত্তম আমল হবে জুমআর দিনে ঈদ হলে জুমআ ও ঈদের সালাত উভয়টাই আদায় করা।

ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময়: একে অপরকে শুভেচ্ছা এবং অভিবাদন জানানোয় পরস্পরের মাঝে বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়। ঈদ উপলক্ষে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরীয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। হাফেজ ইবনে হাজার (রহ) বলেছেন, ‘জোবায়ের ইবনে নফীর থেকে সঠিক সূত্রে বর্ণিত যে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন: ‘আল্লাহ তাআলা আমাদের ও আপনার ভাল কাজগুলো কবুল করুন।’ [আল মুজামুল কাবির লিত তাবারি : ১৭৫৮৯]। ঈদ মুবারক বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। প্রতি বছরই আপনারা ভাল থাকুন: وَكُلُّ عَامٍ وَأَنْتُمْ بِخَيْرٍ বলা যায়।

‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমার ও আপনার সৎ-কর্ম সমূহ কবুল করুন। সারা বছরই আপনারা সুখে থাকুন। আপনাকে বরকতময় ঈদের শুভেচ্ছা।’

আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ খবর নেয়া: ঈদের দিনে আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ খবর নেয়া উত্তম। আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সকল প্রকার মনোমালিন্য দূর করার জন্য ঈদ হল একটা বিরাট সুযোগ। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীস, রাসূল (স.) বলেছেন, ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। যে আল্লাহর সাথে শিরক করে তাকে ব্যতীত সে দিন সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেয়া হয় কিন্তু ঐ দু ভাইকে ক্ষমা করা হয় না যাদের মাঝে হিংসা ও দ্বন্দ্ব রয়েছে। তখন (ফেরেশতাদেরকে) বলা হয় এ দুজনকে অবকাশ দাও যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়! এ দুজনকে অবকাশ দাও যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়! এ দুজনকে অবকাশ দাও যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়।’ (তাহলে তাদেরও যেন ক্ষমা করে দেয়া হয়)। [ মুসলিম : ৪৬৫২ ]

ঈদে যা বর্জনীয়

ঈদের দিন রোজা পালন করা: ঈদের দিন রোজা পালন করলে ঈদের দিনের কাজসমূহ যথাযথ পালন করা যাবে না। সেজন্য হাদিসে ঈদের দিন রোজা পালন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ এসেছে। সহিহ বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আছে, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। ’ -সহিহ মুসলিম: ২৭৩০

বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন: বিজাতীয় আচরণ মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে মুসলমানদের অনেকেই। ঈদের দিনে এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এটা করা যাবে না। সেই সঙ্গে গান-বাজনা করা, অশ্লীল সিনেমা ও নাটক দেখা- যা ইসলাম অনুমোদন করে না, তা থেকে বিরত থাকতে হবে।

বেহুদা কাজে সময় ব্যয় করা: অনেকে বেহুদা কাজে ঈদে রাত জাগরণ ও দিনে বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করে থাকে। সেজন্য বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা দরকার। কোরআনে মুমিনের গুণাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আর যারা অনর্থক কথা-কর্ম থেকে বিমুখ থাকে। ’ -সূরা মুমিনুন: ০৩

জামাতের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায়ে অলসতা করা: ঈদের আনন্দে এমনভাবে উদাসীন থাকেন যে, ফরজ নামাজ আদায়ে অলসতা করেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতএব সেই নামাজ আদায়কারীদের জন্য দুর্ভোগ, যারা নিজেদের নামাজে অমনোযোগী। ’ -সূরা মাউন: ৪-৫

অপচয় ও অপব্যয় করা: ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে এ উপলক্ষে সব কিছুতেই অপচয় ও অপব্যয় করা হয়। অথচ কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা কোনভাবেই অপব্যয় করো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। ’ -সূরা বনি ইসরাঈল: ২৬-২৭

ঈদের দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা: অনেকে এ দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করে থাকেন, যা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে সাব্যস্ত হয়নি। অতএব ঈদের দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা যাবে না। এজন্য রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে এমন ইবাদত করল যাতে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই তা পরিত্যাজ্য হিসাবে গণ্য হবে। ’ -সহিহ মুসলিম: ৪৫৯০ জুয়া খেলা ও আতশবাজি করা: এগুলো শরিয়ত বিরোধী কাজ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। ’ -সূরা মায়িদা: ৯০

মানুষকে কষ্ট দেয়া: ঈদের দিনে অনেকে এমন কাজ করেন যা মানুষকে কষ্ট দেয়। যেমন, রাস্তা আটকিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া, এমন আনন্দ করা যাতে অন্যরা কষ্ট পায়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুসলিম ওই ব্যক্তি যার হাত ও জিহবা থেকে অন্যরা নিরাপদ। ’ –সহিহ বোখারি: ৬৪৮৪

ঈদের নামাজ আদায় না করে কেবল আনন্দ ফুর্তি করা: অনেকে ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে নতুন জামা-কাপড় পরিধান, সেমাই, ফিরনী ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ঈদের নামাজ আদায় করার কথা ভুলে যান। অথচ এই দিনে ঈদের নামাজ আদায় করা হচ্ছে মূল করণীয়।

ঈদ একটি ইবাদত। আনন্দ ও ফুর্তি করার মাধ্যমেও যে ইবাদত পালন করা যায়, ঈদ তার অন্যতম উদাহরণ। শরিয়াসম্মতভাবে আনন্দ প্রকাশ করার বিষয়ে কোরআনে এসেছে, ‘বল, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত, সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম। ’ -সূরা ইউনুস: ৫৮