আবরার হত্যাকাণ্ড: দায় কী কেবল নির্যাতনকারীদের?

মতামত
আলী রীয়াজ

বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় হয়েছে। নিম্ন আদালতের দেয়া এই রায় বিচার প্রক্রিয়ার শেষ নয়। এর পরেও কয়েক ধাপ আছে সেটা আমরা সবাই জানি, প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার বিকল্প নেই। এই রায়ের প্রেক্ষিতে যে ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই প্রশ্ন - হত্যাকান্ডের দায় কেবল যারা ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর রাতে ছাত্রাবাসে আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করেছে তাদেরই কী না।

কেউ কেউ ছাত্র রাজনীতিকেই দায়ী করছেন; স্মরণে থাকবে যে ২০১৯ সালেও এই কথাই বলা হয়েছিলো। কিন্ত এই ধরণের বিষাক্ত ছাত্র রাজনীতির সূচনা কোথায় সেটা না বলে কেবল ‘ছাত্র রাজনীতি’কে দায়ী করার মধ্যে আমি যেটা দেখতে পাই তা হচ্ছে বিরাজনীতিকরণ। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ অবস্থায়ই বুয়েটে এই হত্যাকান্ড হয়েছে সেটা তখনো জানা ছিলো এখনও আছে। কিন্ত যা বন্ধ ছিলোনা তা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ‘রাজনীতি’, তাঁদের কর্তৃত্ব, তাঁদের নিপীড়ন, তাঁদের টর্চার সেল।

সেটাকে একচ্ছত্রভাবে প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ করেন, শিক্ষকরা করেন। তাঁদের জ্ঞাতসারে এই সব ঘটনা ঘটে, এই কথাটি অভিযোগ নয়; যারা স্মরণ করতে চান তাঁরা নিশ্চয় মনে করতে পারবেন যে, বুয়েটের তৎকালীন উপাচার্য সাইফুল ইসলাম সেটা একটি সাক্ষাতকারেই স্বীকার করেছিলেন – ঢাকা ট্রিবিউনে ২৩ অক্টোবর ২০১৯ প্রকাশিত সাক্ষাতকারের শিরোনাম ছিলো – ‘Buet VC admits Chhatra League ran the show’।

তিনি এই হত্যাকান্ড এবং ছাত্রলীগের এইসব কর্মকান্ড ঠেকাতে না পারার জন্যে কোন দায় নিতে রাজী হননি। এটা মোটেই বিস্ময়কর নয়। কবে কোন বিশ্ববিদ্যাল্যের উপাচার্য ছাত্র হত্যার জন্যে দায় নিয়ে বা অনুশোচনায় পদত্যাগ করেছিলেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু বকরের মৃত্যুর সময় একজন উপাচার্য নিশ্চয় ছিলেন, হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর সময়ও ছিলেন। তিনি/ তাঁরা এই নিয়ে অনুশোচনা বোধ করেন এমন কথা ঘুনাক্ষরেও শোনা যায়নি।

বুয়েটের উপাচার্যের সেই সাক্ষাতকারে ফেরা যেতে পারে। তিনি আবরার হত্যার সময় কর্তব্য পালনে অবহেলার জন্যে দায়ী করেছিলেন ছাত্র কল্যাণ ডাইরেক্টরেটকে। উপাচার্যের ভাষ্য অনুযায়ী অনেক দিন ধরেই এই ডাইরেক্টরেট ছাত্রলীগের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। এই ডাইরেক্টরেটের এক সময়কার প্রধান, যিনি ঐ পদ ত্যাগ করেছিলেন যখন ছাত্রলীগের এই সব আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, তিনি এখন বুয়েটের উপাচার্য। উপাচার্য আদালতের রায়ের দ্রুত বাস্তবায়ন চেয়েছেন। সেটা তিনি চাইতেই পারেন, যদিও আমরা জানি যে বিচার প্রক্রিয়ার অনেক ধাপ বাকী আছে।

ফলে এই ধরণের কথা কেবল বাক্যবিস্তার। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে যে পরিস্থিতির কারণে আবরার হত্যার ঘটনা ঘটেছিল তাঁর কি অবসান হয়েছে? সেটা বুয়েটের উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার বলতে পারবেন বুয়েটের ব্যাপারে, কিন্ত সারা দেশের কথা কে বলবে? সেই কথা বলার দায়িত্ব ছিলো সরকারের কিন্ত তার কোনো লক্ষণ নেই, কারণ এই হত্যাকাণ্ডের কুশীলবরা ক্ষমতাসীন দলের লোক। আবরার ফাহাদের হত্যা এবং তাঁর হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণার পরে সরকারের এই দায়ের কথা সুস্পষ্টভাবে বলতে দ্বিধা কেনো সেটাই আমার প্রশ্ন। এই কথাটি ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবরে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলেছিলাম (‘সরকারের দায় নিয়ে কথা বলতে হবে’, প্রথম আলো, ২০ অক্টোবর ২০১৯), এখন আবারো বলতে চাই।

সেই সময়ে লিখেছিলাম – “বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁকে হত্যা করেছেন ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। আবরারকে হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকে তাঁর প্রতিক্রিয়ার কারণে। হত্যা করার উদ্দেশ্যে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘শিবির’-এর সমর্থক বা সদস্য হিসেবে। গত রোববার রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে নিহত আবরারকে নিয়ে যেকোনো ধরনের কথা বলতে হলে এই তর্কাতীত সত্যগুলো স্বীকার করেই বলতে হবে।

এর যেকোনো একটি অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে এই হত্যার দায় থেকে ব্যক্তি, সংগঠন, সরকার, ক্ষমতাসীন দল ও রাষ্ট্রকে দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা। সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখে শোকপ্রকাশ ও ক্ষুব্ধ হওয়ার ভঙ্গি করাকে কেবল মায়াকান্না বললেই যথেষ্ট হবে না, অমানবিক আচরণ বলেই বর্ণনা করতে হবে।”

যারা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তাঁদের বিচারিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকুক, কিন্ত তার অর্থ তো এই নয় যে আবরার এবং এই রকম আরও যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তাঁদের হত্যার জন্যে দায়ীরা দায়মুক্তি লাভ করুক। এই কথাগুলো বলা দরকার সুস্পষ্ট ভাষায়।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর।