গবেষণা তথ্য

করোনার চেয়ে বেশি মানুষ মরেছে আত্মহত্যায়

আত্মহত্যা
করোনার চেয়ে বেশি মানুষ মরেছে আত্মহত্যায়

প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের চেয়ে দেশে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে আত্মহত্যা করে। দেশে করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর প্রথম ১২ মাসের এ রকম ১৪ হাজার ৪৩৬ জন মানুষ আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করেছে। যা একইসময়ে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরণকারী মানুষের মোট সংখ্যার চেয়েও বেশি৷

করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় মানসিক চাপে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অন্তত ৫০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই রয়েছেন ছয়জন। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছেন দুইজন।

বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন ও দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। মোট আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশই নারী। বাকি ৪৩ শতাংশ পুরুষ।

সংস্থাটি বলছে, অন্যান্য সময়ের তুলনায় করোনাকালীন সময়ে আত্মহত্যার প্রবণতা ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়াদের অর্ধেকেরই বয়স ২০ বছর থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। যা মোট সংখ্যার ৪৯ শতাংশ৷ এরপরেই সব থেকে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মানুষেরা, ৩৫ শতাংশ৷ ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী আত্মহত্যাকারী ১১ শতাংশ এবং ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সী ৫ শতাংশ৷

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সময়ে আত্মহত্যার হার নিয়ে ২০২১ সালের মার্চে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন৷

আঁচল ফাউন্ডেশন দেশে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর তথা ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য, পুলিশ ও হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, এই সময়ে ১৪ হাজার ৪৩৬ মানুষ আত্মহত্যা করেছে৷ যা এর আগের বছরের চেয়ে ৪ হাজার বেশি৷

করোনায় মানসিক স্বাস্ব্যসেবা প্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়েছে ৩শ’ গুণ:

‘মনের বন্ধু’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর পরামর্শ সেবা দিয়ে থাকে। সংস্থাটির যাত্রা শওরু হয় ২০১৬ সালে। তারা জানিয়েছে, ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর হঠাৎ করেই সেবা প্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়ে যায়।

সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও তৌহিদা শিরোপা সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, করোনাভাইরাস শুরুর পর জুন পর্যন্ত আমরা প্রায় ৩২ হাজার মানুষ ফ্রি কাউন্সিলিং দিয়েছি৷ এর মধ্যে ৬০ শতাংশই তরুণ৷ তিনি জানান, করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মানসিকজ স্বাস্ব্যসেবা প্রত্যাশীর সংখ্যা ৩শ’ গুণ বেড়েছে।

আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আগে কখনও এত দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল না, ওয়ার্ক ফ্রম হোমের এত ব্যবস্থা অতীতে ছিল না৷ এ সময়ে কেবল অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাই নয়, আরো অনেক নিরাপত্তাহীনতা জীবনে এসেছে৷ শুরুর দিকে অনেকে বলতো, আমার যদি করোনা হয়ে যায়, তাহলে কী করবো এই ভয়টা তখন ছিল৷ কেবল নিজেকে নিয়ে নয়৷ নিজের এবং চারপাশের মানুষদের নিয়েও ছিল ভয়৷ পরের দিকে ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটি বেড়ে গেছে৷’

তরুণ-যুবারাই সবচেয়ে বেশি বিষন্নতার শিকার:

গেল জুলাই মাসে ‘করোনায় তরুণ তরুণীদের মানসিক বিপর্যয়’ শীর্ষক একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে আঁচর ফাউন্ডেশন। মহামারীর এই সময়ে তরুণ-তরুণীদের অবস্থা জানতে এই জরিপটি চালানো হয়েছিল। এতে দেখা যায়, ৬১ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ-তরুণী মানসিক সমস্যায় ভুগছেন৷ জরিপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী এ সময়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন৷ শারিরীকভাবে নিজের ক্ষতি করেছেন ২৯ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ-তরুণী, যেটাকে আত্মহত্যার প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি৷ ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ-তরুণী করোনাকালীন সময়ে আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন৷

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ ডয়চে ভেলেকে জানান, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২১ সালের ফেব্রুয়ারি সময়কালে করা জরিপে দেখা গেছে ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছে৷ যাদের ৪৯শতাংশই ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সের৷ এরপর আমরা তরুণ-তরুণীদের মানসিক অবস্থা বুঝতে এই জরিপটি করি৷

গত ৮ অক্টোবর ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর করোনা মহামারীর প্রভাব: একটি প্রায়োগিক জরিপ’ শীর্ষক আরেকটি জরিপের ফল প্রকাশ করে আঁচল ফাউন্ডেশন।

সেই জরিপে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৪.৬ শতাংশই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন৷ এর মাঝে পুরুষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮০.৩৮ শতাংশ এবং নারী শিক্ষার্থীদের ৮৭.৪৪ শতাংশ এই মহামারীতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন৷

প্রতিবেদনে বলা হয়, এতো বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী মানসিক সমস্যায় ভোগা পরিবার, সমাজ ও দেশকে নিঃসন্দেহে আতঙ্কিত করে তোলে৷

তানসেন রোজ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যে অংশটা ডিপ্রেশনে ভুগছে৷ এদের কিন্তু প্রোডাক্টিভিটি কমে যাবে৷ কারণ ডিপ্রেশনে ভুগলে পড়াশোনা এবং অন্যান্য কাজে মনোযোগ দিতে পারে না তারা৷ এরা যখন ৮-১০ বছর পর সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় বড় জায়গায় যাবে৷ তখন তাদের প্রোডাক্টিভিটি কমার বিষয়টা স্পষ্ট হবে৷ তখন দেশেরও প্রোডাক্টিভিটি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে৷ এখনই তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ না নেয়া হলে ভবিষ্যতে দুরবস্থা তৈরির একটা সমূহ সম্ভাবনা আছে৷’

দেশে মানসিক স্বাস্ব্যসেবার অবস্থা:

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পদক্ষেপ নিয়ে আত্মহত্যার এই হার কমানো সম্ভব বলে মনে করে আঁচল ফাউন্ডেশন৷ কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার সুযোগ খুবই কম৷ সর্বশেষ জাতীয় সমীক্ষা বলছে, কয়েক কোটি মানুষ নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় থাকলেও সেবা পান মাত্র ৭ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ৷

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর কত মানুষ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে তার কোনো হিসেব সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থা বা কারো কাছে নেই৷ মানসিক রোগের বিস্তার সম্পর্কে জানতে দুটি জাতীয় সমীক্ষার তথ্য পাওয়া যায়, উভয়টি করোনাভাইরাস পূর্ব সময়ের৷

এর একটি হয়েছিল ২০০৩-০৫ সালে৷ এই সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, এখানে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের মধ্যে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত৷ ২০১৮-১৯ সালে পরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা হয়৷ এতে দেখা মানসিক রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশে৷

ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য মতে, বাংলাদেশের এখনকার জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৬৮ লাখ৷ এই জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ দাঁড়ায় ২ কোটি ৮০ লাখ৷ অর্থ্যাৎ করোনাভাইরাসের কারণে যদি বাংলাদেশে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের হার নাও বেড়ে থাকে, তাহলেও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ৮০লাখ৷ বিপরীতে দেশে মনোচিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীর সংখ্যা ৯০০ জনের মত।

২০১৮-১৯ সালের সমীক্ষাকে উদ্ধৃত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্তদের মাত্র ৭ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা পায়৷ বাকী ৯২ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে যায় বাইরে৷

২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর একটি ‘সিচুয়েশনাল এসেসমেন্ট’ প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে মনোচিকিৎসক রয়েছে ২৬০ জন৷ সে হিসাবে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য দশমিক এক ছয় জন মনোচিকিৎসক রয়েছেন৷

আর দেশে মনোবিজ্ঞানী রয়েছে ৫৬৫ জন৷ সে হিসাবে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য দশমিক তিন চার জন মনোবিজ্ঞানী আছেন৷ তাদের সবাই মোটামুটি শহর এলাকাতেই সেবা দিয়ে থাকেন৷ আর সাইকিয়াট্রিক নার্স আছে ৭০০ জন৷

দেশে মানসিক হাসপাতাল রয়েছে ২টি। যেখানে মোট বেড ৭০০টি৷ এছাড়া ৫৬টি হাসপাতালে সাইকিয়াট্রিক ইউনিটে আরো ৫০৪টি বেড রয়েছে৷

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাইকোসোশ্যাল ইন্টারভেনশনের’ জন্য যোগ্য জনবলের অভাব সর্বত্র রয়েছে৷ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স পাওয়া গেছে কেবল দুই হাসপাতালে৷ যেখানে অন্য কোন হাসপাতালেই নেই বিশেষায়িত নার্স৷

লুনাসি অ্যাক্ট-১৯১২ রহিত করে ২০১৮ সালে পাস হয় মানসিক স্বাস্থ্য আইন৷ ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি' প্রণীত হয় ২০১৯ সালে, যা এখনো মন্ত্রিসভার সম্মতির অপেক্ষায়৷ অন্যদিকে ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কৌশলগত পরিকল্পনা ২০২০-৩০' এর খসড়া ২০২০ সালে চূড়ান্ত হয়৷ এই পরিকল্পনা সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, এতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সর্বক্ষেত্রে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু এটিও এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি৷

সূত্র: ডয়েচ ভেলে বাংলা