নতুন জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম বাতিলের দাবি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের

ছাত্র ফ্রন্ট
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের লগো

নতুন জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম-২০২০ এ বিজ্ঞান শিক্ষা ও গণিত শিক্ষা সংকুচিত করার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার ভেতরে কারিগরি শিক্ষাকে অনুপ্রবেশ ঘটানোর পায়তারা করা হচ্ছে বলে দাবি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের। সংগঠনটি নতুন কারিকুলামকে ছাত্র ও শিক্ষা স্বার্থ বিরোধী উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছে। একইসঙ্গে শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষানুরাগী মানুষের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে সর্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, সেক্যুলার, একই পদ্ধতির গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি ও কারিকুলাম প্রণয়নের জোর দাবী জানান তারা।

সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শোভন রহমান স্বাক্ষরিত এক যৌথ সংবাদ বিবৃতি এই দাবি জানিয়েছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনটি।

যৌথ বিবৃতিতে সংগঠনের সভাপতি আল কাদেরী জয় ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স বলেন, ‘এই কারিকুলামে কিছু ভালো ভালো কথার আড়ালে শিক্ষা-বৈষম্য, ব্যয় বৃদ্ধি ও রাষ্ট্রের দায়িত্বের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে কৌশলে শিক্ষা ব্যবসাকে উৎসাহিত ও পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী যাতে একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সামগ্রিকতায় জ্ঞান লাভ করে, সেই কথা বলে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত একই বিভাগে শিক্ষা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। পূর্বে যেভাবে ৯ম শ্রেণিতেই বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা এই ৩ বিভাগে ভাগ হয়ে যেত, এখন এটা চলে যাচ্ছে উচ্চমাধ্যমিক থেকে। পূর্বে শিক্ষার্থীরা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান ৩টি বিষয়ে মাধ্যমিকে ৩০০ ও উচ্চমাধ্যমিকে ৬০০ নম্বরের জন্য পড়তো। এখন ৩টি বিষয়কে এক করে দিয়ে তার সাথে প্রযুক্তিও যুক্ত করে ১০০ নম্বর করা হয়েছে।’

নতুন কারিকুলামে বইয়ের বোঝা বাড়লেও জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির সম্ভবনা ক্ষীণ উল্লেখ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে এতে বিজ্ঞান শিক্ষার পরিসর কমে এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বদলে সেখানে যুক্ত করা হয়েছে ভালো থাকা, ধর্ম শিক্ষা, জীবন ও জীবিকা এরকম নতুন কিছু বিষয়। আধুনিক মনন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ সমস্ত বিষয় কী ভূমিকা রাখবে, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে বৈজ্ঞানিক যুক্তির দাবী শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাবিদগণ দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন। কিন্তু এবারের প্রস্তাবনায় বিজ্ঞান শিক্ষার পরিসর কমিয়ে এনে এই বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তারা কী শেখাতে চান সেটা বোধগম্য নয়।’

একই ধারার শিক্ষা আর জগাখিচুড়ি শিক্ষা এক কথা নয় উল্লেখ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘কম বিজ্ঞান পড়ে মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে হঠাৎ বিজ্ঞান বিভাগের পরিসর বেড়ে গেলে শিক্ষার্থীরা চাপের মুখে পড়বে। শাসকদের পরিকল্পনার ফলে এমনিতেই বিজ্ঞান পড়ায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দিন দিন কমছে। মানসম্পন্ন বিজ্ঞান শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। এরপর আবার এই নতুন চাপ এড়াতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিভাগ নিতে আরও বেশি নিরুৎসাহিত হবে। একই ধারার শিক্ষার নামে সবকিছু থেকে এক চিমটি এক চিমটি করে নিয়ে জগাখিচুড়ি পাকানো হচ্ছে।’

নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, ‘আলাদা করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থাকা সত্ত্বেও প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে কারিগরি শিক্ষার দিকে অত্যাধিক জোর দেওয়া হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে একটি কারিগরি বিষয়কে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়াও সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে উচ্চতর গণিত। মৌলিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়কে সংকুচিত করে কারিগরি শিক্ষাকে উৎসাহিত করে মিস্ত্রী তৈরীর অপতৎপরতা তো শাসক গোষ্ঠীর আগে থেকেই ছিল, এই শিক্ষাক্রমের মধ্য দিয়ে কারিগরি শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার মধ্যেও অনুপ্রবেশ করার উদ্যোগ নিয়েছে তারা। শিক্ষা মানে কেবলমাত্র শুধু কিছু কারিগরি দক্ষতা বোঝায় না। দক্ষতা অর্জন করলেই কেবল একজন মানুষকে শিক্ষিত বলা যায় না। শিক্ষা সম্পর্কিত শাসকদের এই দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার মর্মবস্তুর সাথে সাংঘর্ষিক। এটি একজন নাগিরিকের জন্য প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার পথে অন্তরায়।’

নতুন কারিকুলামে শিক্ষকদের হাতে শিক্ষার্থীদের জিম্মি হয়ে থাকবার সম্ভবনা তৈরি হবে উল্লেখ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘১ম থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত কোন পরীক্ষা রাখা হচ্ছে না, তবে থাকবে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন। এ ছাড়াও এই সময়ে থাকছে না কোনো পাঠ্যবই। শিক্ষকরা পড়াবেন তাদেরকে দেওয়া শিক্ষক নির্দেশিকা অনুযায়ী। ৪র্থ থেকে ৫ম শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন ও পরীক্ষা মূল্যায়ন যথাক্রমে ৭০ ও ৩০ শতাংশ, ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ৬০ ও ৪০ শতাংশ, ৯ম ও ১০ম শ্রেণিতে ৫০ ও ৫০ শতাংশ, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩০ ও ৭০ শতাংশ। পরীক্ষার চাপ কমাতে এই পদ্ধতি নেওয়া হলেও এর বাস্তবায়ন করার মত সক্ষমতা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নেই এবং এটা বাস্তবায়ন হবে কীভাবে, তার কোনো পরিকল্পনাও রূপরেখায় নেই। এর সাথে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণের ব্যাপার যুক্ত আছে। ২০১০ সালে যখন সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল, তখনও আমরা দেখেছি শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে এবং অবকাঠামোগত ব্যবস্থা না থাকায় এই পদ্ধতি কোনো ফল বয়ে আনতে পারেনি। এই নতুন কারিকুলামেও একই ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বরাবরের মতই যত ভালো ভালো কথা বলে এটা শুরু করা হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবে পরিণত হবে না।’

নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, শিক্ষকদের হাতে এই বিপুল পরিমাণ নম্বর থাকলে সেটা প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বাণিজ্যকে উৎসাহিত করবে। এছাড়া এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে কার্যকরী করার জন্য যে পরিমাণ ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত দরকার, সেটা বর্তমানে নেই, সেটার ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলাও হয়নি। রূপরেখায় বলা হয়েছে, পরিক্ষার উপর চাপ কমাতে ১ম থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরিক্ষা এবং ১০ম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরিক্ষা হবে না। অথচ ১০ম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পর পর ৩টি পাবলিক পরিক্ষা রাখা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের উপর ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করবে।

নতুন এই কারিকুলাম প্রণয়ণ করা হয়েছে অগণতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিকভাবে উল্লেখ করে তারা বলেন, কারিকুলাম প্রণয়নে কোনো ছাত্র সংগঠন, অভিভাবক প্রতিনিধিদের মতামত নেওয়া হয়নি। এই কারিকুলামের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হিসেবে একটি বিজ্ঞানের প্রতি বিরুপ মনোভাবাপন্ন প্রজন্ম গড়ে উঠবে। তারা মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন ও গবেষণা করবে না, মানুষ হিসেবে তাদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ হবে না, শিক্ষার নামে যন্ত্রের মত শুধুমাত্র কিছু দক্ষ কারিগর বা মিস্ত্রী তৈরী হবে।