নিউ নরমাল জীবন

চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা পদ্ধতি ও আবেদনের বয়সজনিত অচলায়তন

৩২ আন্দোলন
সাজিদ সেতু

বিগত বৃহস্পতি ও শুক্রবার বাংলানিউজ ২৪ ও প্রথম আলোর দুটি সংবাদ বেশ আলোড়িত হয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাংলানিউজ ২৪ এর শিরোনাম ছিলো ‘‘চাকরির জন্য ছুটতে গিয়ে বাসচাপায় প্রাণ গেলো যুবকের’’। প্রথম আলোর স্টোরি ছিলো রংপুর গঙ্গাচড়া থেকে আসা মোশারফ হোসেন ইডেন কলেজের সামনে কাঁধে দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে অপেক্ষারত যেহেতু ভেতরে উনার স্ত্রী চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন।

শুক্রবারে অভিজ্ঞতা হওয়া আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করছি যেখানে একজন মা চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন আর কেন্দ্রের বাইরে ১০ দিন বয়সী সন্তানকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন তার বাবা। বিসয়টি আসলে দেশের চাকরির বাজারের খন্ড চিত্র মাত্র, যা রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে সকল নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট। সেই সাথে কোভিডকালীন ‘নিউ নরমাল’ জীবনে একই দিনে ৬/৭ টি নিয়োগ দানকারী (কখনও ১০ এর অধিক) প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা নেওয়ার বৈষম্যমূলক ও জনস্বার্থ বিরোধী সিস্টেম চাকরীপ্রত্যাশী যুব প্রজন্ম চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর করোনায় ২ বছর বয়স হারিয়ে ফেলার দগদগে ঘা তো আছেই, যার উপর ব্যাকডেট নামক অসম পদ্ধতির প্রবর্তন ক্ষতের তীব্রতা বাড়িয়েছে।

করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দরুণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কেন্দ্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কেও নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উদ্যোগটির সাথে চাকরিতে নিয়োগের পরীক্ষার যোগসূত্র বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কোভিডের লকডাউন শীর্ষক দীর্ঘ বিরতি শেষে এখন একই দিনে অনেক নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করছেন (টাকা দিয়ে আবেদন করা বিজ্ঞপ্তিতে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ না পাওয়া অবশ্যই আইনসঙ্গত নয়); যার ফলে হাজার হাজার কখনও লাখের কাছাকাছি চাকরিপ্রত্যাশী রাজধানী ঢাকাতে প্রতি সপ্তাহে যাতায়াত করছে। এটি ঘটছে যখন কোভিডের ২য় ঢেউ আমাদের দেশে চলমান। আমরা কি জনপ্রশাসনের একাডেমিক টার্ম 'Decentralization' ভুলে গেলাম? এই পরীক্ষাগুলি (অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন তারিখে) যদি বিভাগীয় শহরে নেওয়া হয় তাহলে ঢাকা অভিমুখে এভাবে জনসংখ্যার চাপ হয় না; বড় একটি চাকরিপ্রত্যাশী প্রজন্ম নিজ নিজ বিভাগীয় শহরে বিভাজিত হয়ে সমস্যার মুখোমুখি না হয়ে পরীক্ষা দিতে পারে। লাখ লাখ বেকারকে এমনিতেই 'উল্লেখযোগ্য অংকের পরীক্ষার ফি' প্রদান করে আবেদন করতে হয়৷ এরপর নিয়মিত বিরতিতে ঢাকায় যাতায়াতের খরচ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।

করোনাকালীন অর্থনৈতিক দৈন্যতায় অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদেরকে বেছে নিতে নিতে হয় কোন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে ঢাকা যাবে যেহেতু ঢাকায় যাওয়া আসার পরিবহন ও অন্যান্য খরচ বহন করার 'বিলাসী সামর্থ্য' অনেকেরই থাকেনা। করোনায় লক্ষ লক্ষ পরিবারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিম্নগামী হয়ে গেলেও সন্তানের চাকরিতে অাবেদনের ফি তাঁরা কষ্ট করে হলেও প্রদান করেন। কিন্তু রাজধানী যাতায়াতের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছেলে মেয়েদের সব অাবেদন করে রাখা নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতেই অংশগ্রহণের সুযোগ দিচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে নারী চাকরিপ্রত্যাশীদের অনেকেই ছোট বাচ্চাসহ আসেন রাজধানীতে চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য।

কোভিড পরবর্তী বিশ্বে অনেক সিস্টেমই পরিবর্তিত হয়েছে এবং হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য হোক বা অর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে হোক অনেক সিস্টেমকে 'fine tuning' বা 'business re-engineering' করা হয়েছে 'নিউ নরমাল' পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে। আর আমরা যেহেতু একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রে বসবাস করি সুতারাং চাকরি প্রার্থীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিবেচনায় নিতে হবে যার মধ্যে মানবিক বিবেচনাও অন্তর্নিহিত রয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি বর্তমান পরিস্থিতিতে বিকেন্দ্রীকরণ পদ্ধতিতে বিভাগীয় শহরগুলোতে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাগুলি অনুষ্ঠিত হওয়ার মতো যুগোপযোগী ইস্যু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টিগোচর হবে এবং তারা জনকল্যাণমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

করোনার আঘাতে এদেশে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ততার স্বীকার শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী যুব প্রজন্ম যেহেতু সকলেই তাদের জীবন থেকে ২টি বছর হারিয়ে ফেলেছে। বিগত ৬ মাস ধরে শিক্ষার্থীরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলনরত অবস্থায় দাবি জানিয়ে আসছেন, জাতীয় সংসদে বার বার উত্থাপিত হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া ২ বছর ফিরিয়ে দিয়ে আবেদনের বয়সসীমা ৩২ বছরে উন্নীতকরণের বিষয়টি। এই পরিস্থিতি এমন সময়ে যখন বাংলাদেশ 'Demographic Dividend' এর সময়কাল পার করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি প্রায় ৪ লাখ পদ শূণ্য আছে যে সংখ্যা সরকারি সকল ডিপার্টমেন্টে জনবল ঘাটতির উদাহরণ বহন করে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনা করে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩২ বছরে উন্নীতকরণ এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার মতো সিদ্ধান্তের ঘোষণা সরকারি কতৃপক্ষের নিকট হতে আসবে এটিই এখন সময়ের ও প্রজন্মের গণদাবি।

প্রথম আলোর সিনিয়র কলামিস্ট আলতাফ হোসেন এর একটি কলামে আমরা জেনেছিলাম সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়টি উপস্থাপিত হলে সিনিয়র আমলাগণ 'চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩২' এর যৌক্তিক বিষয়টি বিবেচনায় নিবেন। যদিও করোনাকালে উনাদের কোন বয়সজনিত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় নি, তবে সামগ্রিক বিবেচনায় অবসরের বয়স ৫৯ থেকে ৬০ বছরে উন্নীতকরণ হতেই পারে যেহেতু বাংলাদেশে পেশাজীবি মানুষ সাধারণত ৬০ বছর অবধি কর্মক্ষম থাকেন৷ অবসরের পর চুক্তিভিত্তিক কাজ করার অগণিত উদাহরণ তো রয়েছেই। করোনায় সকল বয়সী শিক্ষার্থীদের যে ২ বছর হারিয়ে গেছে এর ফলে চাকরিপ্রার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া ২টি বছর ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সকল বয়সী শিক্ষার্থীদের নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগটুকু দেওয়া একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রে অগণতান্ত্রিক বা অযাচিত প্রত্যাশা নয়।

একটা প্রশ্ন রেখে যেতেই হচ্ছে - চাকরীপ্রত্যাশী যুব প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন/মাস্টার্স পর্যায়ে থমকে আছে যাদের বয়স ২৭ এর ঘরে। মাস্টার্স এর রেজাল্ট প্রকাশের পর চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা তথা চাকরির বাজারে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য তারা চলমান ৩০ এর সিস্টেমে কত বছর সুযোগ পাবেন?

লেখক: সমন্বয়ক, চাকরিপ্রত্যাশী যুব প্রজন্ম