সুইস ব্যাংক নামে কোন ব্যাংকই নেই সুইজারল্যান্ডে!

প্রযুক্তি
বিশ্বজুড়ে ধনীরা কেন সুইস ব্যাংকে টাকা রাখতে পছন্দ করে? প্রথম কারণ হচ্ছে নিরাপত্তা।

আমাদের সবার পরিচিত একটি রহস্যময় ব্যাংকের নাম হচ্ছে সুইস ব্যাংক। আমরা অনেকেই মনে করি এটা একটা গোপন ব্যাংক যেখানে কেবল মাত্র অবৈধ অর্থ জমা করা হয়। আবার, অনেকের ধারণা সুইস ব্যাংকে কেবল অত্যন্ত ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা একাউন্ট খুলতে পারেন এবং এখানে প্রচুর লাভ দেয়া হয় ইত্যাদি। 

আপনি জানলে খুব অবাক হবেন যে, কথাগুলো সঠিক নয়। সুইস ব্যাংক নামে কোন ব্যাংকই নেই! সুইজারল্যান্ডের সকল ব্যাংক-কে একত্রে বলে ‘সুইস ব্যাংক’। ইংরেজি ‘Swiss Banks’ শব্দটিকে বাংলা করতে গিয়ে হয়ে গেছে ‘সুইস ব্যাংক’। অর্থাৎ, সমগ্র সুইজারল্যান্ডে ছোট বড় মাঝারি মোট ২৪৬টি ব্যাংক আছে, যাদেরকে একত্রে ‘সুইস ব্যাংক’ বলা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুইটি ব্যাংক হল ক্রেডিট সুইস ও ইউবিএস। সুইজারল্যান্ডের সকল নাগরিকই সুইস ব্যাংক ব্যবহার করে, তাই সুইস ব্যাংক গুলো যে কেবল ধনীদের অর্থ সঞ্চয়ের জন্য় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ব্যপারটা এমন না। সবশেষে, সুইজারল্যান্ডের সুদের হার বেশি তো নয়ই বরং পৃথিবীর সবচেয়ে কমের মধ্যে একটি। বর্তমান মাসে সুইজারল্যান্ডের ইউবিএস ব্যাংকের সেভিংস এর উপর সুদ মোটামুটি ০.০০% ছিল।

আর মোটের উপর এই দেশের গড়পড়তা সুদের হার -০.৩৮ যাচ্ছে। মানে, এখানে টাকা রাখলে আজকাল উল্টো এদেরকেই সুদ ‘দিতে’ হয় এমন অবস্থা!

তাহলে, প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে ধনীরা কেন সুইস ব্যাংকে টাকা রাখতে পছন্দ করে? প্রথম কারণ হচ্ছে নিরাপত্তা। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো অত্যন্ত নিরাপদ, ব্যাংক ব্যবস্থার উপর সরকার কোন হস্তক্ষেপ করে না। দেশ হিসেবেও সুইজারল্যান্ড অত্যন্ত নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ। কোন বিশ্বযুদ্ধে সুইজারল্যান্ড অংশ গ্রহণ করেনি এবং ভবিষ্যতে করার ব্যাপারেও আগ্রহী নয়। সর্বদা মধ্যপন্থী হওয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে একই সাথে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর এবং ইহুদিদের সম্পত্তি একসাথে জমা ছিল। 

আরও পড়ুন: ফেসবুক মুদ্রা কি এবং আমেরিকা কেন তার অনুমোদন দেয়নি

সুইস ব্যাংকগুলোর প্রতি আকর্ষণের অন্যতম আরেকটা কারণ হচ্ছে সেই দেশের মুদ্রা, ‘সুইস ফ্রাঙ্ক’। খুব ভালো অর্থ ব্যবস্থা (Monetary Policy) থাকায় সুইস ফ্রাঙ্ক বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে অত্যন্ত স্থিতিশীল একটা মুদ্রা। আপনি যদি আজকে ৫০ কোটি টাকার মেক্সিকান পেসো বা জিম্বাবুইয়ান ডলার কিনে রাখেন, রাজনৈতিক সমস্যার কারণে অথবা এই দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে দেখা যেতে পারে, দুই বছরে মুদ্রার মান কমে ২৫ কোটি টাকা হয়ে গেল। তখন কিছুই করার থাকবে না। সুইজারল্যান্ডের রাজনৈতিক সংকট এতই সীমিত এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি এতটাই স্থিতিশীল যে হুট করে সম্পদ হারানোর ভয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।

তবে অন্য সকল দেশের চেয়ে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং সেক্টরের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে গ্রাহকের তথ্যের গোপনীয়তা। আইন অনুযায়ী সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোর জন্য তাদের গ্রাহকদের তথ্য ও পরিচয় কারো কাছে প্রকাশ করার বিধান নেই। অর্থাৎ, পৃথিবীর যে কোন দেশের সরকার বা প্রতিষ্ঠানের কাছে এখানের গ্রাহকদের সকল ফাইনান্সিয়াল তথ্য গোপন থাকবে। ফলে একজন ধনী ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ কিংবা ধরিবাজ সরকারি কর্মকর্তা তার নিজ দেশের সরকার পতন বা ক্ষমতার পালাবদল কিংবা হুট করে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ধরা পড়লেও টাকা হারানোর ভয় করবে না। কারণ তার সকল জমা-খরচের তথ্যই গোপন থাকবে তার সরকারে-প্রশাসন-আইনশৃংখলা বাহিনী-বিচার বিভাগ-তদন্ত কমিশনের কাছে। এই ব্যবস্থার চমৎকারিত্ব হচ্ছে যে গ্রাহক ভাল-মন্দ-সাধু-দুর্নীতিবাজ-সৈ রশাসক যাই হোক না কেন, সুইস ব্যাংক কারো সাথেই কোন বৈষম্য করবে না। আপনি তাদের একজন গ্রাহক এবং সকল গ্রাহকই সমান সুবিধা ও সুযোগ পাবে। গ্রাহকের টাকা নিরাপদে রাখা ও পরিচয় গোপন করাই এই ব্যাংকগুলোর মূল আকর্ষণ ও দায়িত্ব। তাই, প্রত্যেক কালো টাকার মালিকই চায় তাদের টাকা নিরাপদে থাকুক এবং তাদের সকল তথ্য গোপন থাকুক যেন কোন দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে সম্পদের হিসেবের কোন হদিস না থাকে। সুইস ব্যাংকগুলো যেহেতু এই দায়িত্ব যত্নের সাথে পালন করে আসছে তাই সবাই এখানেই তাদের টাকা রাখতে পছন্দ করেন। আগেকার দিনে সম্পদকে নিরাপদে রাখতে জলদস্যুরা খুঁজে বের করত দূর-দুরান্তের নির্জন দ্বীপ আর সাধারণ মানুষ নিজের বাসায় খুঁড়ত গর্ত। বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ডাকাতগুলোর লুটের মালের সবচেয়ে বড় পাহারাদার ও রক্ষাকারী হল সুইজারল্যান্ড। 

আরও পড়ুন: মুদ্রা ব্যবস্থার কালো দিবসের ৫০ বছর পূর্তি!

ক্রমাগত চাপের মুখে সম্প্রতি আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সুইজারল্যান্ড কিছুটা নমনীয় হয়েছে। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাস থেকে সুইস কর সংস্থা অন্যান্য রাষ্ট্রের কর সংস্থার কাছে শর্ত সাপেক্ষে সীমিত পরিসরে তথ্য প্রদান করতে সম্মত হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে সুইস ব্যাংক গুলোর প্রতি কর ফাঁকিবাজদের আকর্ষণ আগের তুলনায় কমেছে। এদিকে পানামা, কেম্যান আইল্যান্ড কিংবা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড এর মত দেশের ব্যাংকগুলো, যারা এই আধুনিক যুগে ডাকাতি করা লুটের মালের পাহারাদার হতে চায়, লুটেরাদের কাছে এই দেশগুলোর ব্যাংকের প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে।

লেখক: নরওয়ে স্কুল অফ ইকোনোমিক্স, মানহাইম বিসনেস স্কুল, জার্মানি

mohaiminpatwary@gmail.com