কিছু তিতা কথা

চলচ্চিত্র
আশফাক নিপুন

গত অনেক মাস ধরে অভিনেতা (পুরুষ ও নারী), পরিচালকদের ইন্টারভিউতে একটা প্রশ্ন কমন দেখেছি, সেটা হল সিণ্ডিকেট বিষয়ক। দেশের প্রথম সারির পত্রিকাসমূহ থেকে শুরু করে ভুঁইফোড় অনলাইন পোর্টালগুলোয় একটা প্রশ্ন সাংবাদিকরা করেছেনই মিডিয়ার কিছু পরিচালক, অভিনেতাদের সিণ্ডিকেটবাজি নিয়ে।

এই সিণ্ডিকেট শব্দটাই আপত্তিকর এবং উষ্কানিমূলক কারণ কোন পরিচালক যদি তার পছন্দ অনুযায়ী কোন অভিনেতার সাথে একের পর এক কাজ করে যান সেটা সম্পূর্ণ তার স্বাধীনতা। তেমনি কোন জুটি যদি তুমুল দর্শকপ্রিয় হয়ে একের পর এক কাজ করতে থাকেন তাহলে সেটাও কোনো সিণ্ডিকেট হয়ে যায় না। তাহলে তো উত্তম-সুচিত্রা, সত্যজিত-সৌমিত্র, ট্যারেন্টিনো-স্যামুয়েল জ্যাকসন, স্করসিসি-ডি নিরো, রাজ্জাক-কবরী, আফজাল-সুবর্ণা, হুমায়ুন আহমেদ-আসাদুজ্জামান নূরসহ সবাই সিণ্ডিকেট হয়ে যেতেন। কিন্তু উনাদের বেলায় 'সিণ্ডিকেট' শব্দটা ব্যবহার হত না, হচ্ছে হাল আমলে। কেন অহেতুক এই বিতর্ক তৈরী করা?

দর্শককে যদি মধ্যমণি ধরা হয় তাহলে দর্শকই ঠিক করে দেবে কার কাজ সে প্রথমে দেখবে, কার কাজ পরে দেখবে, কোন কাজ বারবার দেখবে বা কোন কাজ দেখবেই না। অমুক অমুক শিল্পী, পরিচালক, টিভি চ্যানেল, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সিণ্ডিকেট করে তমুক তমুক শিল্পী, লেখক, পরিচালক, কলাকুশলীদের উঠতে দিচ্ছে না এই আলাপ হাস্যকর।

আরেকটা অপ্রাসঙ্গিক বিতর্ক ‘ভিউ বাণিজ্য’। কোন কাজ যদি মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয়ে যায়, ধরে নেয়া হয় কাজটা খারাপ। কোটি ভিউ হলেই যেমন সব কাজ মানোত্তীর্ণ, কালোত্তীর্ণ হয়ে যায় না, তেমনি কোটি ভিউকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ারও কিছু নাই। প্রতিটা কাজের আলাদা দর্শক শ্রেণি থাকে, কিছু কাজ তৈরী হয় সকল শ্রেণির দর্শককে তুষ্ট করার কথা মাথায় রেখে সহজ ভঙ্গিতে, সেগুলোর কিছু কোটি ভিউ পার করে, সাধারণত রোমান্টিক আর কমেডি ধাঁচের কাজ হয় সেগুলো। এখন কালোত্তীর্ণ হবে কিনা সেটা সময় বলে দেবে কিন্তু সাময়িকভাবে সেই কাজ এত সংখ্যক দর্শককে আকৃষ্ট করতে পেরেছে সেটা যে কারণেই হোক, এটাকে ফেলনাভাবে উপস্থাপন করার কিছু নাই। যুগে যুগে জনপ্রিয় কাজ যেমন ছিল, কালোত্তীর্ণ কাজও ছিল। একটা কালোত্তীর্ণ ‘জীবন থেকে নেয়া’ যেমন ছিল, একটা তুমুল জনপ্রিয় ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ও ছিল। একটা ব্লকবাস্টার ‘মনের মাঝে তুমি’ যেমন ছিল, একটা ক্লাসিক ‘মাটির ময়না’ও ছিল। প্রতিটার গল্প ভাবনা, নির্মাণ ভঙ্গি আর দর্শক আলাদা। কারো সাথে কারো বিরোধ নাই। অহেতুক বিতর্ক তৈরী করে শিল্পী আর শিল্পে বৈরী ভাব তুলে কি লাভ?

সর্বশেষ হল ‘রিভিউ কালচার’। এখন ফেসবুকে বেশ কিছু গ্রুপ আছে যেখানে কন্টেন্ট নিয়ে আলোচনা হয়। দর্শকহীনতার যুগে দেশী কন্টেন্ট নিয়ে যে টুকটাক মতামত বিনিময় হয় সেটাও কম না। আমি সেগুলাকে ‘রিভিউ’ বলি না কারণ এক্সপার্ট রিভিউয়ার আমাদের দেশে নাই বললেই চলে, গ্রুপগুলোতে হয় আলোচনা। কোন কাজ কারো পছন্দ বা অপছন্দ হলে সেটা নিয়ে কেউ তার ভাল লাগা, মন্দ লাগা জানায় যেমন বিদেশী অনেক ছবি দেখে আমরাও আমাদের ফেসবুকে সেটা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি। এটা নিয়েও দেখি এখন প্রচুর বিতর্ক। অমুকের কাজ নিয়ে কোনো লেখালেখি হল না, অমুক কাজ নিয়ে অহেতুক এত লেখালেখি হল কেন? সাধারণ দর্শকের উপরে ভরসা না রেখে অল্প কিছু সংখ্যক গ্রুপের আলাপ আলোচনা যদি এখন এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে শিল্পী, নির্মাতা, কলাকুশলী, সাংবাদিকের কাছে তাহলে আসলে বলার কিছু থাকে না। প্রতিটা কাজ আলোচিত হয় তার মেধা অনুযায়ী। একটা ভাল কাজকে আপনি কোনোভাবেই যেমন দমিয়ে রাখতে পারবেন না, তেমনি একটা কম ভাল কাজকেও হাজার হাজার প্রমোট করে আলোচনায় আনতে পারবেন না। এটা যারা মনে করেন তার বোকার স্বর্গে বাস করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের প্রথম তুমুল দর্শকপ্রিয় একটা ওয়েব সিরিজ নিয়ে দেশের প্রথম সারির পত্রিকায় কোন নিউজ, ফিচার, সমালোচনা, ফলো আপ, ইন্টারভিউ কিছুই করা হয় নাই। তাতে কি সেই ওয়েব সিরিজ নিয়ে আগ্রহ, আলোচনায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েছে? কম জনপ্রিয় হয়ে গেছে কাজটা? হয়নি। কাজেই এখানে অহেতুক দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক কাল্পনিক শত্রু-বন্ধু পক্ষ/গ্রুপ তৈরী করে অজুহাত খোঁজার কিছু নাই।

কোন গ্রুপের লেখালেখিই শুধু যেমন ‘বড় ছেলে’র তুমুল জনপ্রিয়তা নির্ধারণ করে দেয় না, তেমনি কোন গ্রুপের আলাপ আলোচনার কারণেই শুধু ‘ঊনলৌকিক’ এর মত সিরিজ দর্শক তৈরী করে না। যেকোন কাজ তার মেধা, নিয়তি অনুযায়ীই স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছায়।

এত এত বাক্যব্যয় আসলে গত বেশ অনেক মাস ধরে বেশ কিছু ইন্টারভিউতে নেতিবাচক আলোচনা, বিতর্ক উষ্কে দেয়ার টক্সিক প্রবণতা দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে করা। পুরো পৃথিবীর সিনেমা, ওয়েব মানচিত্রে সামগ্রিকভাবে আমরা মাত্র প্রথম কদম দিতে শুরু করেছি। অহেতুক বিতর্ক, দায় চাপাচাপি, অজুহাত খোঁজা, স্কুপ তৈরী করে এই যাত্রা বিলম্বিত বা বিতর্কিত করলে আখেড়ে আমাদেরই ক্ষতি।

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা