দেশ পরিচালকদের শিক্ষার মানে কমতি আছে

মতামত
কামরুল হাসান মামুন

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের শিক্ষার মান ২.৮%, ভারত ও শ্রীলঙ্কার শিক্ষার মান যথাক্রমে ২০.৮% এবং পাকিস্তানের শিক্ষার মান ১১.৩%! আবার ২০২০ সালে CEOWORLD magazine-এর তৈরী পৃথিবীর সেরা এডুকেশন সিস্টেমের একটি ইনডেক্স প্রকাশ করে। সেই ইনডেক্সে ভারতের অবস্থান ৩৩, শ্রীলংকার অবস্থান ৭৭, পাকিস্তানের অবস্থান ৮৩, মায়ানমারের অবস্থান ৯২ আর আমার প্রাণের বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এইরকম USNEWS এর তৈরী আরেকটি ইনডেক্স দেখলাম সেখানে ভারত ২৪ নম্বরে, শ্রীলংকা ৪৭ নম্বরে, মায়ানমার ৫৮ নম্বরে, ভিয়েতনাম ৪০ নম্বরে আর মোট ৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে খুঁজে পাইনি। এছাড়া গত বছর দেখেছি ওয়ার্ল্ড নলেজ ইনডেক্সে দক্ষিণ এশিয়ার তলানিতে বাংলাদেশ। আবার রিসার্চ ও ইনোভেশন ইন্ডেক্সেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তলানিতে। অথচ আমাদের কি ভাব? আমরা নাকি উন্নয়নের মহাসড়কে। পৃথিবী নাকি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে আর আরো বেশি করে অবাক হয়। Bragging কাকে বলে বিশ্বকে আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি!

এমনটাইতো হওয়ার কথা। আমাদের শিক্ষায় বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন, শিক্ষকদের বেতন ও সুবিধাদি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। রিসার্চ ও উন্নয়ন নামে বাজেটে একটি খাত থাকে। আমাদের সেটি একদম নাই। গবেষণায় বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তলানিতে বাংলাদেশে। এই রকম একটি পরিস্থিতিতে কিভাবে আশা করব আমরা শিক্ষায় পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ভারত থেকে ভালো করব? সরকার যদি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ করে সেটা করার আগে শিক্ষা ও গবেষণার কথা না ভেবে যদি দলের কথা ভেবে একজন দলান্ধ ব্যক্তিকে ভিসি বানায়, সরকার যদি কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগের সময় দলের কথা ভাবে তাহলে দেশের শিক্ষার মান কিভাবে ভালো হবে? গত পরশু শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি বলেছেন, ‘ঘটনাচক্রে শিক্ষক হবেন না, শিক্ষকতা পেশাকে স্বপ্ন হিসেবে ধরেই আসতে হবে।’ আচ্ছা এই বেতন, অপমান যেই চাকুরীতে সেখানে শিক্ষকতা পেশা হিসাবে কোন বলদে নিবে?

এমন একটি অবস্থায় সরকার আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক লেভেলের কাররিকুলাম পরিবর্তন করছে। করে কি করছে? যেখানে সারা পৃথিবী নবম-দশম শ্রেণিতে প্রথম বারের মত শিক্ষার্থীদের কাছে পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও রসায়নকে আলাদা সাবজেক্ট হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় সেখানে আমরা তিনটিকে এক করে বিজ্ঞান নামে একটি সাবজেক্ট বানাচ্ছি। সারা পৃথিবীর মত যেখানে এখন তিনটি আলাদা সাবজেক্ট ছিল তথাপি এইসব বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা ভালো করছিল না সেখানে এগুলোর গুরুত্ব কমিয়ে দিলে তখন কেমন মানের শিক্ষার্থী পাব? আমাদের মন্ত্রণালয় কি করল? আমাদের একটা কারিগরি বোর্ড আছে সেখানে যে সব বিষয় পড়ানো হয় এবং পড়ানো উচিত সে সব সাবজেক্ট এখন বাংলা মাধ্যমে আনা হচ্ছে। অর্থাৎ মেইনস্ট্রিম শিক্ষাকে এখন আমরা কারিগরি শিক্ষার কাছাকাছি নিয়ে গেছি। আমি হলফ করে বলতে পারি নতুন এই নিয়ম কার্যকরী হলে দেশের শিক্ষার ২৪টা বেজে যাবে। আমরা যদি আমাদের শিক্ষাকে বাঁচাতে চাই তাহলে নতুন এই সিস্টেমকে প্রতিহত করতেই হবে।

যতদিন শিক্ষাকে মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখা হবে ততদিন বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নতি হবে না। কারণ আমাদের মন্ত্রণালয় শিক্ষার উন্নয়নে facilitator বা সহায়ক হিসাবে কাজ না করে নিয়ন্ত্রক হিসাবে কাজ করে। তারা শিক্ষককে যতভাবে পারে অপমান অপদস্ত করে। বেতনে করে, সম্মানে করে, সুযোগ সুবিধা তৈরিতে করে। এর একটি বড় প্রমান হলো প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা দেওয়া। একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে আদরের জায়গা, ভালোবাসার জায়গা হলো প্রাথমিক লেভেলের শিশু শিক্ষার্থীরা। তাদের শিক্ষকদের যদি তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়া হয় এই শিক্ষার্থীদের তাহলে মডেল মানুষ কারা হবে? সুতরাং এই অসুস্থ সাইকি এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে সহসা এইটা যাবে না। তাই শিক্ষাকে বাঁচাতে শিক্ষকদের জন্য একটা আলাদা বেতন স্কেল করে তাদের নিয়োগ ও প্রমোশনের জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন করা যেতে পারে।

কয়েকদিন আগে বিশ্বখ্যাত নেচার জার্নালে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে গরুকেও potty training-এ সফল হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের মানুষ এখনো রাস্তাঘাটে প্রাকৃতিক কাজ সারে। এখনো তাদের রাস্তাঘাট পার হওয়ার ট্রেনিং দেওয়া যায়নি। এখনো মানুষ যেখানে ময়লা ফেলে। এই লিস্ট ধরে লেখা শুরু করলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে। মূল প্রশ্ন হলো কেন এমন? উত্তর খুব সহজ। শিক্ষার মান প্রায় শুন্যের কাছাকাছি। শিক্ষার মানের এই অবস্থা কেন? কারণ অন্তত গত ৩০ বছর ধরে কোনো সরকার শিক্ষার গুরুত্ব বুঝে এর জন্য যা করা প্রয়োজন করেনি। আমাদের দেশটা যে এমন হযবরল তার মূল কারণ শিক্ষার মানের অভাব। শিক্ষার মানের অভাব কারণ আমাদের দেশকে যারা চালায় তাদের শিক্ষার মানের কমতি আছে। আমরা কি এই সাইকেল চলতে দিতেই থাকব? গরুকে ট্রেইন করা যায় কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে ট্রেইন করা যায় না!

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়