সম্পর্কে ‘পই-পই’ হিসাব কতটা বাস্তবসম্মত

সম্প্রতি সোস্যাল মিডিয়ায় ‘পই-পই’ হিসেব কথাটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ফলে সম্পর্কে এমন হিসেব কতটা জরুরী, তা আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন নেটিজেনরা
সম্প্রতি সোস্যাল মিডিয়ায় ‘পই-পই’ হিসেব কথাটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ফলে সম্পর্কে এমন হিসাব কতটা জরুরী, তা আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন নেটিজেনরা

সম্প্রতি সোস্যাল মিডিয়ায় ‘পই-পই’ হিসেব কথাটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ফলে সম্পর্কে এমন হিসাব কতটা জরুরী, তা আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন নেটিজেনরা। অন্যদিকে অনেকে এমন হিসেবের সমালোচনাও করেছেন। কেননা, তারা মনে করেন যে, কেবল হিসেবের মানদণ্ডে ফেলে সব সম্পর্ক টিকে রাখা সম্ভব নয়।

তাই নেটিজেনদের এমন দ্বিধাবিভক্তি চিন্তাধারার সমাধান কোথায়? চলুন বাস্তব কিছু ঘটনার সাথে মিলিয়ে দেখা যাক-

জীবনের চলমান ঘটনা প্রবাহ ও পই-পই হিসেবের ফল-

জীবনে চলার পথে খুবই তুচ্ছ ঘটনাগুলোর হিসেব করতে গিয়ে যেমন সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে, তেমনি হারিয়ে যেতে পারে প্রিয় মানুষ ও ভালবাসা। আমরা হরহামেশাই এমন কিছু জিনিস লক্ষ্য করি। যেমন, সোস্যাল মিডিয়ায় খুবই আগ্রহ নিয়ে একটা লেখা কিংবা সবচেয়ে সুন্দর কোন ছবি পোস্ট করার পর বিশেষ করে কাছের মানুষদের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় মনের মধ্যে বড় কোন এক্সপেক্টেশন রাখি। কিন্তু কিছু প্রিয় জনের প্রতিক্রিয়া আসলেও অনেকে এ তালিকায় বাদ পড়ে যান।

ফলে মনে মনে তাদের উপর এক ধরনের বিরক্তি আসার পাশাপাশি পুঞ্জিভূত হতে থাকে অনাকাঙ্ক্ষিত অবিমানও। সেই বন্ধু কিংবা প্রিয় মানুষটির কোন পোস্ট আপনিও এমনভাবে এড়িয়ে যান, যা খুব ভালো ভাবে সেও বুঝতে পারে। ফলে তার মধ্যেও এমন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফলস্বরূপ এক পর্যায়ে পরস্পরের মধ্যে কথাবার্তা কমতে শুরু করে এবং দূরত্ব বাড়তে থাকে।

একইভাবে কোন বন্ধু খুবই আগ্রহ নিয়ে একটা কথা বলার জন্য ছুটে আসল কিংবা ফোন করল, কিন্তু তখনই আপনি তার আগ্রহের সঠিক মূল্যায়ণ করতে পারলেন না। অথবা খুব বিপদে কিছু টাকা চেয়ে কোন বন্ধু পেল না। যা তার ইগোতে আঘাত করল। এটা হতে পারে আপনার প্রতি তার অধিক প্রত্যাশা কিংবা ভালবাসা থেকে। ফলে সে ওই বন্ধুর প্রতি আগের মতো আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং দূরত্ব বাড়াতে থাকে।

এমনি চিত্র আমরা বৈবাহিক জীবনেও দেখি। স্ত্রী গরমে সেদ্ধ হয়ে স্বামীর জন্য কোন প্রিয় রেসিপি করেছে। কিন্তু খেয়ে স্বামী ভাল কোন ফিডব্যাক দিল না। ফলে স্ত্রী কষ্ট পেয়ে অন্যভাবে তার উপর অভিমান ঝাড়তে লাগলে স্বামীর ইগোতে লাগে। ফলে তাদের মাঝে হাসিমুখে কথা কমতে শুরু করে এবং দূরত্ব বাড়ার পাশাপাশি ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মান-অভিমান ও ঝগড়াঝাটি প্রতিনিয়ত লেগেই থাকে।

এমতাবস্থায় ব্যক্তি জীবনে নেমে আসে হতাশা। পরস্পরকে ঘিরে সৃষ্টি হয় একটি চাপা ক্ষোভ ও কষ্ট। মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করলেও, জিতে যায় তাদের ইগো।

সব সময় মনে হতে থাকে, সে যদি আগে কথা না বলে, আমি বলব কেন? সে যদি ফোন না করে, আমি করব কেন? অথচ সেসময় ওই ব্যক্তির সাথেও এমন অনেক ঘটনা ঘটতে পারে/ সেও আপনার মতো কোন কারণে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে, যেটা আপনি জানেন না। কিন্তু ক্ষুদ্র এসব কারণে প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে অনেক সম্পর্ক এবং হারিয়ে যাচ্ছে সেই প্রিয় মানুষগুলো।

অথচ তুচ্ছ এই বিষয়গুলোতে ‘পই-পই’ হিসেব না করে যদি ক্ষমা সুন্দর সৃষ্টিতে দেখা যায়, তবে আজীবন টিকে যায় এই সম্পর্কগুলো। কেননা, ক্ষমা করার মানে হলো কাউকে নতুন কিছু করার সুযোগ দেয়া।

গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা যখন ক্ষমা করার পরিবর্তে মনে রাগ ও অসন্তোষ পুষে রাখি, তখন আমরা আসলে নিজেদেরই ক্ষতি করি। এই ধরনের নেতিবাচক অনুভূতি আমাদের ব্যক্তিগত আনন্দ কেড়ে নিতে পারে এবং আমাদের কষ্ট বাড়িযে দিতে পারে। এ ছাড়া, এটা গুরুতর শারীরিক সমস্যা নিয়ে আসতে পারে।

ডা. ইয়োয়িচি চিডা এবং মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যন্ড্রু স্টেপটো জার্নাল অফ দি আমেরিকান কলেজ অফ কার্ডিয়োলজি-র একটা রিপোর্টে বলেছেন, “সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গিয়েছে, রাগ, শত্রুতা এবং হৃদরোগের মধ্যে এমন একটা সম্পর্ক রয়েছে, যেটা মানুষের ক্ষতি করে।”

এবিষয়ে জোনাথন হুইয়ি বলেছেন, ‘অন্যরা ক্ষমার যোগ্য এজন্য ক্ষমা নয় বরং নিজের মনের প্রশান্তির জন্যই ক্ষমা।’

ক্ষমার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত

আমরা জানি বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর তায়েফ অভিযানের সেই ঘটনা। যখন বিশ্বনবী তায়েফের কাফের-মুশরিকদের ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়েছিলেন, তখন তারা নবীকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করার পাশাপাশি পাথর নিক্ষেপ করে রক্তাক্ত করেছিলেন।

এমতাবস্থায় ফেরেস্তা এসে তায়েফ জাতিকে ধ্বংস করার কথা বললে নবী বলেছিলেন, তাদের ধ্বংস করলে ইসলামের দাওয়াত দিব কার কাছে! অতঃপর তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। এর ফলে পরবর্তীতে ওই তায়েফবাসীই ইসলামের ছায়াতলে এসে নবীকে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাতে শুরু করেছিলেন।

ইতিহাসে ক্ষমার এমন হাজারো দৃষ্টান্ত রয়েছে। যা মান-অভিমান ও শত্রুতাকে চিরতরে বিদায় করে সম্পর্কগুলোকে করে আরো বেশি শক্তিশালী এবং সমাজ, রাষ্ট্র ও জনজীবনে বয়ে আনে এক প্রশান্তির নব বার্তা।

ইসলাম, বোদ্ধ, হিন্দু, খ্রিষ্টানসহ প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থেই ক্ষমাকে মহৎ গুণ হিসেবে অ্যখ্যায়িত করা হয়েছে। এ বিষয়ে জগৎ বিখ্যাত মনীষীগণও বিভিন্ন উদ্বৃত্তি দিয়েছেন। ক্ষমার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘ক্ষমাই যদি করতে না পারো, তবে ভালবাসো কেন?’

পল বোসে বরেন, ‘ক্ষমা কখনো অতীতকে পরিবর্তন করতে পারে না, তবে ভবিষ্যতকে আরো বড় করতে পারে।’ রবার্ট মুলার বলেন, ‘ক্ষমা হলো ভালোবাসার সবচেয়ে বড় রূপ যার প্রতিদান হিসাবে আপনি পাবেন হাজারো ভালোবাসা।’ আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন, ‘দুর্বল লোকেরা প্রতিশোধ নেয়, শক্তিশালীরা ক্ষমা করে দেয় এবং বুদ্ধিমানরা এড়িয়ে চলেন।’ হযরত আলী (রা) বলেন, ‘ক্ষমাই হলো সবচেয়ে বড় প্রতিশোধ।’

সুতরাং তুচ্ছ বিষয়ের ‘পই-পই’ হিসেব ভুলে ক্ষমা করতে শিখলে যেমন থাকবে না কোন হতাশা বিষন্নতা ও দুঃখ-কষ্ট, তেমনি মনে ফিরে আসবে প্রশান্তি ও প্রিয়জনের প্রতি ভালবাসা। তবে যারা সম্পর্কে দোহাই দিয়ে সর্বাদা প্রতারণা করে, তাদের এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়