‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’ গানের পেছনের গল্প

গান
সাবিনা ইয়াসমীন, মলয় কুমার গাঙ্গুলী এবং হাসান মতিউর রহমান

‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই ...’ গানটি বছরের নানান সময় এবং নানান দিবসে বেজে ওঠে বারবার। টেলিভিশন চ্যানেলে বারবার প্রচার হয় গানের ভিডিও, বেতারে শোনা যায় গানটি।

জাতীয় শোক দিবসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অসংখ্য স্ট্যাটাসে দেখা যায় গানের লাইন, ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’। গানটা জাতীয় শোক দিবসের শিরোনাম সংগীতের মতো হয়ে গেছে। খুব আবেগ এবং দরদভরা গান।

আশির দশকের শেষভাগে সামরিক সরকারের চোখ-রাঙানি উপেক্ষা করে সুরকার মলয় কুমার গাঙ্গুলী ও গীতিকার হাসান মতিউর রহমানের হাত ধরে সৃষ্টি হয় গানটি। মলয় কুমার গাঙ্গুলী প্রথমে গাওয়ার পর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝির দিকে শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গানটি মানুষের মুখ থেকে মুখে ছড়িয়েছে।

গানের পটভূমি নিয়ে বঙ্গবন্ধুভক্ত মলয় কুমার গাঙ্গুলী জানান, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের যাতনা থেকেই তিনি এমন একটি গান করার পরিকল্পনা করেন।

তখন তিনি মতিঝিলের গভর্নমেন্ট কলোনিতে থাকতেন। সেই সময়ের জনপ্রিয় গীতিকার হাসান মতিউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ গান লেখার প্রস্তাব দেন, গানের কথায় কোন পরিস্থিতি তুলে আনতে হবে সেই ধারণাও দেন এ সুরকার।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লেখার প্রস্তাব পাওয়ার পর হাসান মতিউর রহমান ভেবেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় মাপের একজন নেতাকে নিয়ে গান লেখা সহজ কথা না। সংশয় ঝেড়ে গানটি লিখে মলয় কুমার গাঙ্গুলীকে দিলে তিনি প্রশংসা করেন, সুরও করে ফেলেন।

ততদিনে গীতিকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন হাসান মতিউর; তার লেখা গান কণ্ঠে তুলে আলোচনায় এসেছিলেন দিলরুবা খান, মুজিব পরদেশী। তবে জাতির পিতাকে নিয়ে এটিই ছিল তার লেখা প্রথম গান।

৭৬ বছর বয়সী শিল্পী ও সুরকার মলয় কুমার গাঙ্গুলীর ভাষ্যে, তখনকার পরিস্থিতি ছিল এমন যে, আওয়ামী লীগের কথা বলা যাবে না, বললেই বিপদ। রাজনৈতিক নেতারাও কথা বলতে সাহস পেতেন না। ওই সিচুয়েশনে আমরা গানটা করেছি।

সেই পরিস্থিতির কথা উঠে এল হাসান মতিউর রহমানের বক্তব্যেও, তখন রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সাবলীলভাবে কোনো কাজ করা সম্ভবপর ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যেত না। খুব চাপ ছিল।

পরবর্তীতে শাসকদের রোষাগ্নির মুখেও পড়েছিলেন বলে জানিয়ে মলয় কুমার গাঙ্গুলী বলেন, আমার উপর নিয়ে অনেক ঝড় গেছে। আমাকে কোয়ার্টার ছাড়তে হল। চাকরিও গেল সেই গানটার জন্য।

“প্রেস ক্লাবের সামনে জনতার মঞ্চ আমার গান দিয়ে ওপেন হয়েছিল। সেখানে শেখ হাসিনা ছিলেন, তার পাশেই আমি ছিলাম। ওই সময় পুলিশ সতর্ক করেছিল, ‘দাদা, আমরা কিন্তু বাধ্য হচ্ছি; বাসায় থাকবেন না’। আমাকে পালিয়ে থাকতে হয়েছিল।”

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচারণার জন্য হাসান মতিউর রহমানের অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চেনা সুর থেকে মলয় কুমার গাঙ্গুলীর কণ্ঠে ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’সহ কয়েকটি গান নিয়ে একটি ক্যাসেট প্রকাশের পর গানটি ছড়িয়ে যায়।

সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগে ক্ষমতায় আসার শেখ হাসিনার পরামর্শে শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন দিয়ে গানটি গাওয়ানো হয় বলে জানান হাসান মতিউর রহমান। গানের সংগীতায়োজন করেন প্রয়াত সুরকার ফরিদ আহমেদ।