বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে কলেজে ভর্তির বিপক্ষে ভর্তিচ্ছুরা, যা বললেন ভিসি

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি

বিগত বছরগুলোতে দেশের প্রথম সারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হতো। তবে এবার তা সম্পূর্ণরূপে ব্যতিক্রম। করোনার কারণে একদিকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে, চলমান করোনা পরিস্থিতিতেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশের সব কলেজে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করেছে।

এসব কলেজে স্নাতক প্রথমবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার আবেদনের কার্যক্রম গত বুধবার (২৮ জুলাই) থেকে শুরু হয়েছে। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এ আবেদন চলবে আগামী ১৪ আগস্ট পর্যন্ত। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে অনলাইনে ক্লাশ শুরু হবে। এবারও এসএসসি ও এইচএসসির ফলের ভিত্তিতে ভর্তি নেওয়া হবে। ফলে এবারও কোনো ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে না।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আগেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কলেজে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। করোনাকালে এমনিতেই মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে আয় আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে। এমতাবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হওয়ায় ঝুঁকি এড়াতে আগেই একবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং পরবর্তীতে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হলে সেক্ষেত্রে দুই জায়গায় অর্থ ব্যয় করতে হবে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু করোনাকালে এই বাড়তি অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য অনেক পরিবারেরই নেই৷ ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আগে কলেজে ভর্তির সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ শিক্ষার্থীরা।

তাদের মতে, করোনার কারণে এখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি সেক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করলে তুমুল প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে যাদের একমাত্র লক্ষ্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেসকল শিক্ষার্থীরা।

এদিকে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বলেছেন, পর্যাপ্ত আসন থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অপেক্ষা করতে গেলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই পিছিয়ে পড়বে। তাই ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের মধ্যে রাখতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন-ইউজিসি বলছে, এতে শুধু শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ভোগান্তি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শূন্য আসন পূরণ করতে সমস্যায় পড়তে হবে। আবার দুই জায়গায় ভর্তি হতে হলে শিক্ষার্থীদেরও বেশি অর্থ ব্যয় হবে।

ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, এ পদ্ধতিতে ভোগান্তি বাড়বে শিক্ষার্থীদের। কারন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যদি আগে ভর্তি করে তাহলে কিছু শিক্ষার্থী একবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে ভর্তি হবে, পরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলে চলে যাবে।

তিনি আরও বলেন, আমার কাছে মনে হয় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোটা ঠিক হবে না। তারা আগে যেভাবে ভর্তি করত, সেটাই অনুসরণ করা উচিত। কারণ আমরা যে হয়রানিটা কমানোর জন্য গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতি চালু করেছি, এভাবে ভর্তি হলে সেটা তো থেকেই যাবে। আমরা সেই হয়রানিটা চাই না। ইউজিসির পক্ষ থেকে আমরা এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আলোচনা করব।

ফেনী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী জাহেদুল হক বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি নেওয়ায় আমরা বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বিপাকে। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া অনেকেই হয়তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে। কিন্তু বিকল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন সবাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করছে।এতে করে মাঝারি মানের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রত্যাশিত বিষয় পাবে না৷

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আগেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া চালু হওয়ায় সীদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হচ্ছে। প্রতিবছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পর যারা ভর্তির সুযোগ পাননা একমাত্র তারাই খুব অনায়াসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয় নিয়ে ভর্তি হতে পারে। কিন্তু এখন আমাদের উভয়দিক থেকে চাপে পড়তে হচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাব নাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অপেক্ষা করবো?

ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, যারা ডাবল জিপিএ-৫ প্রাপ্ত তারাও এখন বিকল্প হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকবে৷কিন্তু যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হবে তখন এদের মধ্যে অনেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে এবং তারা সেখানেই ভর্তি হবে৷ কিন্তু যারা কম জিপিএ পেয়ে পাবলিকে চান্স পাবে না তাদের কি হবে? তারা তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও হারাবে সাথে শেষ সম্বল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও হারাবে। শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা করে কর্তৃপক্ষের দ্রুত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী মো. শাহরিয়ার ফারুক ভূইয়া বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে না টিকলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় কারণ বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই বেসরকারিভাবে পড়াশোনা করার সামর্থ্য থাকেনা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করার ফলে ঝুঁকি এড়াতে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা রাখেন তারাও এখানে ভর্তি হবেন।

ফারুক বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পরবর্তীতে পাবলিকে চান্স হলে ভর্তি বাতিল বা নতুন করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে একটা বাড়তি খরচ বহন করতে হবে। এসব শিক্ষার্থীদের কারণে যাদের সত্যিই ইচ্ছা বা শেষ সুযোগ ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তারা পছন্দের প্রতিষ্ঠান বা বিষয় পাবেনা। এমনকি অনেকে ভর্তিও হতে পারবেনা।

আরেক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেন বলেন, সত্যি বলতে অনেকের কাছেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একমাত্র অপশন, আবার অনেকের কাছে তা অন্ধের যষ্টি। বর্তমান পরিস্থিতি যেহেতু অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে না তাই স্বভাবতই সবাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করবে। ফলে যাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় লক্ষ্য ছিলো সেসব শিক্ষার্থী বিপাকে পড়বে৷

চট্টগ্রাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী মেহেরাব উদ্দিন অর্নব বলেন, কোনোভাবেই অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম শুরুর করার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হতে পারেনা৷ কারণ ঝুঁকি এড়াতে সবাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার টাকা দিয়ে ভর্তি হবে এবং আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকায় চান্স পেলে সেখান আবার ভর্তি হবে। এক্ষেত্রে দুই জায়গায় ভর্তি হতে হবে অনেক শিক্ষার্থীকে। করোনাকালে এমনিতেই অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে আর্থিক সংকট রয়েছে। তার উপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আগাম ভর্তির জন্য টাকার জোগান শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বাড়তি চাপ৷

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী দুর্জয় চ্যাটার্জি কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে লেখেন, যারা এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে এবং পরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে তাদের কি হবে?পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তির জন্য সময় দিবে ৩ দিন। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বাতিল করতে কম করে হলেও ২ দিন সময় লাগবে। যদি দু’দিনে না হয়ে,সময় আরো বেশি লাগে তখন কি হবে?

দুর্জয় বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ৬-৭ হাজার টাকা লাগবে,পরে আবার ভর্তি বাতিল করতে লাগবে আরো টাকা। করোনার প্রকোপ ঠেকাতে লকডাউনের কারণে অনেকেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে বাড়তি টাকা জোগার করতে অনেকেই হিমশিম খাবে৷

সার্বিক বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, গত কয়েক বছর ধরেই আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গেই ভর্তি কার্যক্রম চালিয়ে আসছি। সেখানে দেখেছি, ১ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তির পর চলে যায়। এ জন্য আমরা দ্বিতীয় রিলিজ স্লিপের মাধ্যমে মেধাক্রম অনুযায়ী ভর্তি করে থাকি। তবে এবার যদি দেখি বেশি শিক্ষার্থী চলে গেছে, প্রয়োজনে তৃতীয় রিলিজ স্লিপের ব্যবস্থা করা হবে।

উপাচার্য আরও জানান, যেসব শিক্ষার্থী চলে যায় তাদের ভর্তির টাকা ফেরত দিতে নানা জটিলতা হয়। তবুুও এবার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।