কাগজে-কলমে ভর্তিতেই শেষ হচ্ছে কলেজ জীবন

কলেজ
ক্যাম্পাসে ক্লাসের ফাঁকে গল্প-আড্ডা মিস করছে গত বছর এইচএসসিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা

করোনায় দুমড়ে-মুচড়ে গেছে গেল বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা (এসএসসি) পাস করা শিক্ষার্থীদের কলেজ জীবনের স্বপ্ন। প্রায় ১৬ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কাগজে-কলমে কলেজে ভর্তি হলেও কলেজে আর যাওয়া হয়নি এসব শিক্ষার্থীদের৷ অথচ আগামী বছরের মাঝামাঝিতেই শেষ হতে যাচ্ছে এসব শিক্ষার্থীদের কলেজ জীবনের শিক্ষাবর্ষ।

স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবনের নতুন অধ্যায়কে ঘিরে শিক্ষার্থীদের নানান জল্পনা-কল্পনা থাকলেও করোনায় অনিশ্চিত শিক্ষার মারপ্যাঁচে পরা এসব শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে এখন শুধুই হতাশা। করোনায় দীর্ঘ বিড়ম্বনার শিকার এসব শিক্ষার্থীদের আছে যেমন কলেজে না ফেরার আক্ষেপ তেমনি আছে একরাশ হতাশা ও মানসিক অশান্তি। দ্রুত সংকট কাটিয়ে এখন কলেজ জীবনের ফেরার অপেক্ষায় এসব শিক্ষার্থীরা৷

এ প্রসঙ্গে আক্ষেপ প্রকাশ করে চট্টগ্রামের ইসলামিয়া ডিগ্রী কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী মো. আসিফুর রহমান বলেন, শুধু কাগজে-কলমেই ভর্তি হয়েছি কলেজে কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলায় কলেজে আর পা রাখা হয়নি।

তিনি বলেন, অধীর আগ্রহ নিয়ে যখন কলেজ জীবনের অপেক্ষা করতাম তখনও কি কেউ ভেবেছিলাম আমাদের অনলাইনে ক্লাস করতে হবে? শিক্ষকদের সাথে পরিচয় হতে হবে অনলাইনে? স্কুল জীবনে কলেজ নিয়ে যে পরিকল্পনাগুলো করেছিলাম তার কিছুই পূর্ণতা পেল না। এখন ও কলেজের পোশাক গায়ে জড়াতে পারিনি, নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো, নতুন বন্ধু তৈরি, ক্যাফেটেরিয়ায় আড্ডা, সবই যেন এখন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে৷ পড়াশোনার মাঝে ও যেন এক কৃত্রিমতার ছোঁয়া।

রংপুর সরকারি সিটি কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী জান্নাত জাহান জুলি বলেন, শিক্ষা জীবনের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সময় কলেজ জীবন। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবন ঘিরে সবারই বেশ কৌতুহল কাজ করে। কিন্তু করোনা থাবায় এখনো ফেরা যায়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনায়। অনলাইন ক্লাস করেই কাটছে আমদের কলেজ জীবন। যদিও অনলাইন ক্লাস কখনই কলেজ গিয়ে সশরীরে পড়ার পরিপূরক হতে পারে না। এটি যেমন আমাদের জীবনাচরণকে ব্যপক পরিবর্তন করছে তেমনি সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ মানসিক সমস্যা। সারাদিন কলেজ এ পড়াশোনার পাশাপাশি সব বন্ধুদের সাথেও গল্প-আড্ডা হয় যা আমাদের মন-মানসিকতাকে আরো চাঙ্গা করে তোলে৷ কিন্তু দীর্ঘদিন বাসায় থাকায় যেমন মানসিক সমস্যা ও হতাশা কাজ করছে তেমনি পড়াশোনার উপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। করোনার প্রাদুর্ভাব কাটিয়ে টিফিন টাইমে বন্ধুদের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো আবার ফিরে আসবে,একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সপ্ন দেখব। এমনটাই প্রার্থনা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে।

রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড স্কুল এন্ড কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী সেজানুর রহমান বলেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাধ্যমিক পরীক্ষার পর কতই না আশা, কল্পনা, স্বপ্ন ছিলো কলেজ নিয়ে। কিন্তু করোনার প্রকোপে কলেজ জীবন কাটছে অনলাইনে। স্বপ্নই থেকে গেল কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠান ।

তিনি আরও বলেন, অনলাইন ক্লাসের ধারাবাহিকতা সম্পূর্ণ যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ করে দিয়েছে আমাদের। শিক্ষকদের সাথে ক্লাস করা হয় ঠিকই কিন্তু ক্লাসরুমের পরিবর্তে করতে হয় এক কৃত্রিম পরিবেশে। দীর্ঘদিন এই যান্ত্রিকতা যেন একেবারে কোণঠাসা করে দিয়েছে। কলেজ জীবন কী কখনো পাওয়া হবে না?এই যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ কৃত্রিম পরিবেশ ছেড়ে কলেজের ক্লাসরুমে বন্ধুদের সাথে বসে ক্লাস করার আশাটা কী পূরণ হবে না? প্রশ্নগুলো মনে ভীষণ দাগ কেটে যায়।

রংপুরের মাহিগঞ্জ কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী জান্নাতী আক্তার বলেন, স্কুল জীবনে ভাবতাম কলেজ জীবন কতই না মজার৷নতুন পরিবেশে যাওয়ার পর নিজের কাছে একটু ইতস্তত মনে হয় ঠিকই, কিন্তু কয়েকদিন গেলে সবই ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু করোনায় কলেজ জীবন বন্দি অনলাইনে সবকিছু ঠিক থাকলে এখন হয়তো নিজেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী বলে পরিচয় দিতাম। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়ে উঠলো না। করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে আমরা আগের স্বাভাবিক জীবনটাই ফিরে পেতে চাই। আমরা আগের স্বাভাবিক জীবনটাই ফিরে পেতে চাই। কলেজে গিয়ে ক্লাস করা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, বই-খাতা–ব্যাগ নিয়ে ব্যস্ততা সবই যেন এখন দূরের স্বপ্ন মনে হয়।

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল হাকিম বলেন, মহামারির মধ্যেই অনলাইনে ভর্তি হলাম শত আশার প্রিয় কলেজে। কলেজের ক্যাম্পাস, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক-শিক্ষিকা সবই নতুন। কলেজ জীবনের নতুন অধ্যায় নিয়ে কৌতুহলের যেন শেষ নেই। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন করোনার কাছে বন্দি।কলেজ জীবন কাটছে অনলাইনে। প্রথম দিকে অনলাইন ক্লাস ভালো লাগতো কিন্তু এখন অনেকটাই অনীহা কাজ করে। সর্বোপরি এখন দিনক্ষণ গুনছি প্রিয় ক্যাম্পাসে ফেরার।

শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অনলাইন ক্লাস চালু থাকলেও সেখানেও দেখা দিয়েছে চরম বৈষম্য। শহরের কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারলেও পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধা ও স্মার্টফোন না থাকায় মফস্বলের শিক্ষার্থীর বেশিরভাগই বঞ্চিত হচ্ছে এসব অনলাইন ক্লাস থেকে৷ ফলে পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে অনেক শিক্ষার্থী৷ ভালো কলেজে ভর্তি হয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে কলেজ জীবনের আনন্দই উপভোগ করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ক্যারিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় কলেজ জীবন। স্কুল জীবন অতিক্রম করে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে কলেজ জীবন একটা স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্ন যখন জীবন থেকে হারিয়ে যায় তখন শিক্ষার্থীদের ভেতর হতাশা,মানসিক চাপ, ক্লান্তি কাজ করবে এটিই স্বাভাবিক।

ড. আনোয়ারা আলম বলেন, আমাদের দেশের শহর ও প্রান্তিক পর্যায়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা রয়েছে যারা উচ্চশিক্ষা অর্জন করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এসব শিক্ষার্থীদের জীবনে করোনা এক বিশাল ধাক্কা। এই ধাক্কা সামাল দিতে শিক্ষার্থীরা অনেকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষার্থী মানসিক অশান্তি কাটাতে মাদকের উপর ঝুঁকে পড়ছে, হতাশায় আবার কেউ কেউ আত্নঘাতীও হয়ে উঠছে।

তিনি আরও বলেন, সংকট কাটিয়ে উঠতে তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দ্রুত ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও নীতিনির্ধারকদের আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে৷ কারণ আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের সম্পদ৷