অনিশ্চিত শিক্ষাজীবন, পড়াশোনা ছেড়ে ই-কমার্সে ঝুঁকছেন শিক্ষার্থীরা

ই-কমার্স
ছেলেদের তুলনায় মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে অনলাইন ব্যবসায়

করোনার প্রকোপের কারণে প্রায় ১৫ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এক ধরণের নাজুক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে মানসিক চাপ, হতাশা, একঘেয়েমি, আর্থিক টানাপোড়েন, টিউশন সংকটসহ নানান সমস্যায় ভুগছেন শিক্ষার্থীরা। বিপর্যয় এড়াতে তাই অনেকেই আবার বেছে নিচ্ছেন অনলাইন ব্যবসা অর্থাৎ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম।

করোনাকালে ই-কমার্সে আশার আলো দেখছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থী। এসব তরুণদের নতুন সম্ভাবনা এখন ই-কমার্স। বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে বেড়েছে অনলাইনে পণ্য কেনার আগ্রহ, সেইসঙ্গে বাড়ছে ই-কমার্সের উপর নির্ভরশীলতা। আর মানুষের এ চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এ সময়ে স্বল্প পুঁজিতে অনেক শিক্ষার্থীই শুরু করেছেন অনলাইন ব্যবসা। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে অনলাইন ব্যবসায়। অনেকেই পাচ্ছেন আশানুরূপ সাফল্য।

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী সানজিদা ফেরদৌসী লাবণ্য জানান, মহামারিতে অনেক কিছু বন্ধ হয়ে গেলেও খাবারের চাহিদা কোন অংশে কমে যায়নি।তবে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের অনিশ্চয়তায় অনেকেই বাইরের খাবার ক্রয়ের সাহস করতে পারছিলেন না। আর এথেকেই আমার স্বাস্থ্যসম্মত বাসায় তৈরি খাবার সরবারাহের পরিকল্পনা মাথায় আসে।বর্তমানে ফাস্টফুড আইটেমের পাশাপাশি আমি ফ্রোজেন ফুড
সরবারাহের কাজ করছি। শুরুটা একদম স্বল্প পরিসরে হলেও সকলের উৎসাহ এবং ভালবাসায় এখন বেশ বড় পরিসরে আমার ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

রাজশাহী বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মারিয়া তন্নি জানান,আমার শুরুটা ছিল হ‍্যান্ডপেইন্ট পোশাক আর গয়না নিয়ে। শিক্ষা জীবনে অনলাইন ব্যবসা করার মূল কারণ নিজেকে সাবলম্বী করা। অনলাইনে হওয়ায় ঘরে বসেই আমি আমার কাজগুলো খুব সহজে করতে পারছি।যেহেতু সময়ের সাথে সাথে মানুষ ইন্টারনেট জগতে বেশি ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তাই এই প্ল্যাটফর্ম বেছে নেওয়া। আগ্রহ থাকলে সল্প পুঁজি দিয়েই অনলাইনে খুব সুন্দরভাবে নিজের ব্যবসা গুছিয়ে নেওয়া সম্ভব।

চট্টগ্রাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু ছাত্রী সাইফা নাসরিন জানান, করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে তা পুরোপুরি অনিশ্চিত, এজন্যই অনলাইন ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছি। সর্বপ্রথম বন্ধুদের দেখাদেখি এই প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে উৎসাহী হয়েছি। স্বল্প পুঁজি দিয়ে আমি আমার ব্যবসা শুরু করি।

“বর্তমানে আমি মেয়েদের জুয়েলারি, মেকাপ, ব্যাগ সহ বিভিন্ন সামগ্রী অনলাইনে বিক্রয়ের কাজ করছি। মেয়েদের জন্য ই-কমার্স বেশ ভালো একটা প্ল্যাটফর্ম। ঘরে বসে খুব সহজেই কাজ করা যায় বলেই ইদানীংকালে মেয়েরা ই-কমার্সে বেশি ঝুঁকছে যা নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য রীতিমতো আশার আলো।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) নৃবিজ্ঞান বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্র মিশকাতুল ইসলাম বলেন, করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে অনলাইন ক্লাস চলছে। এর বাইরে বাকি সময়টা কাজে লাগাচ্ছি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে। যেহেতু এখন জৈষ্ঠ্যমাস, মৌসুমি ফলমূলের সমারোহ। তাই উদ্যোগ নিয়েছি উন্নতমানের কেমিক্যাল মুক্ত তাজা ফল সরবারাহের। কেমিক্যাল মুক্ত তাজা ফল সংগ্রহের বিষয়টা অনেক চ্যালেঞ্জিং। নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে ফলের মান, গুণাগুণ যাচাই করে ঐ ফল গ্রাহকদের কাছে সরবারাহ করার চেষ্টা করছি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ফিশারিজ বিভাগের ছাত্রী ও তরুণ উদ্যোক্তা সালমা নাওয়ার বলেন, ই-কমার্স শুরুর আগে আমার কোন ধারণাই ছিলনা। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে পড়াশোনার চাপ ছিল খুবই কম। করোনাকালীন অবরুদ্ধ জীবনে হতাশা ও মানসিক বিপর্যয় থেকে বাঁচতে তাই অনলাইন ব্যবসায় মন দিয়েছি।

“আমি রান্না করতে খুবই পছন্দ করি। তাই আমি মূলত খাবার আইটেম দিয়েই ই-কমার্স শুরু করি। খাবার সামগ্রী বিক্রয়ের জন্য ফেসবুকে একটি পেজ খুলি আমি। বন্ধুদের উৎসাহে আমি এই পেজটা খুলি প্রথমে আমার তেমন আগ্রহ না থাকলেও নিয়মিত অর্ডার এবং ক্লায়েন্ট দের রিভিউ আমাকে একাজে উৎসাহিত করেছে। আমার পেজের মাধ্যমে বর্তমানে আমি বাসায় তৈরি পিৎজা, পাস্তা, কেকসহ বিভিন্ন খাবার বিক্রি করছি।আমার কাছে ই-কমার্স প্লাটফর্মটা বেশ সাচ্ছন্দ্য মনে হয়। ঘরে বসেই আমি উপার্জন করতে পারছি বাসায় তৈরি বিভিন্ন খাবার বিক্রয়ের মাধ্যমে।”

আরও পড়ুন: ই-কমার্সে ঝুঁকছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট উদ্যোক্তারা

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. আনোয়ারা আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, করোনায় যেহেতু দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ তাই অনেক শিক্ষার্থী বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা হতাশা, একাকীত্ববোধ, বিষন্নতা, মানসিক চাপ, অর্থনৈতিক টানাপোড়েনসহ নানান সমস্যায় ভুগছেন। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অনেক শিক্ষার্থী শুরু করেছেন অনলাইন ব্যবসা কিংবা ই-কমার্স যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক বলা যায়।

“পড়াশোনার পাশাপাশি ঘরে বসেই অনলাইন ব্যবসায় আয়ের পথ খুঁজছেন শিক্ষার্থীরা।ফলে একদিকে যেমন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার বিকাশ ঘটছে অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারছে।”

তিনি আরও বলেন, অনলাইনে পণ্য ক্রয়ে যেহেতু সাধারণ মানুষের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে ফলে অনেক শিক্ষার্থী এখন উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে।এতে করে শিক্ষার্থীদের যেমন অর্থনৈতিক সংকট ও পারিবারিক চাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি মিলবে অন্যদিকে বেকারত্ব নামক অভিশাপ ধীরে ধীরে কমে আসবে। আমাদের উচিত এসব তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেওয়া।