জাতির মেরুদণ্ড রক্ষা করুন

সাখাওয়াত সজীব
সাখাওয়াত সজীব

সকালে হোটেলে প্রবেশ করলাম, নাস্তা করার জন্য। হাত ধুয়ে বসতে যাবো সেই মুহূর্তে চোখে পড়ল বাড়ন্ত শরীরের চাইতে মাপে কিঞ্চিত ছোট, পুরোনো একটা স্কুল ড্রেস পড়া বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার এক কিশোরকে। আমার খুব পরিচিত তন্ময় (ছদ্মনাম) সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করার পর একটা টেবিলে বসলাম, ভাবলাম নাস্তা কেনার জন্য তন্ময় ছেলেটা হয়তো হোটেলে এসেছে।

ক্ষণিক পর লক্ষ্য করলাম, ও টেবিলগুলোতে পানি সার্ভ করছে। আমার টেবিলে আসার পর হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করলাম: কি খবর? তুমি হোটেলে কাজ করছো কখন থেকে? সে উত্তর দিলো এই তো বেশ কিছুদিন। বললাম: পড়াশোনা আর করবে না? ওর উত্তর: অনেক দিন স্কুল বন্ধ, পড়াশোনা নেই। তাই আব্বু বলেছে স্কুল কবে খুলবে ঠিক নেই, এভাবে বসে বসে না খেয়ে কিছু টাকা ইনকাম কর। তারপর এই হোটেলে দিয়ে যায়।

আমি প্রশ্ন করলাম, তোমার পড়াশোনার ইচ্ছে নেই? সে বললো, ইচ্ছে আছে কিন্তু যে অবস্থা মনে হচ্ছে আর হবে না। (কথাগুলো বলার সময় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো) পাশের টেবিল থেকে একটা চিৎকার আসলো, ওই পিচ্চি, এই টেবিলে পানি দে। ডাক শুনে ও দ্রুত ওইদিকে ছুটলো, যাওয়ার সময় বললো ভাইয়া, কাস্টমারের চাপ বেশি গেলাম।

বাজার থেকে মেসে যাবো দীর্ঘসময় থেকে অপেক্ষা করছি একটা ভ্যানও পাচ্ছি না। দুএকটা আছে ওরা (চালকরা) পা ঝুলিয়ে বসে আছে বললো যাবেনা।

বললাম, বসেই তো আছেন মামা, দিয়ে আসেন?
বললো: না এখন ওইদিকে (ভেতরে যাবে না)।
মনে মনে ভাবলাম, সব জমিদার হয়ে গেছে।

আরো কিছু সময় পর দূর থেকে দেখলাম ২ জন যাত্রী নিয়ে একটা ভ্যান বাজারের দিকে আসছে। দূর থেকেই হাত দিয়ে ইশারা করার চেষ্টা করলাম যাতে অন্য কেউ নিয়ে না নিতে পারে। কাছে আসার পর কিঞ্চিৎ আশ্চর্যই হলাম চালকের আসনে বসে আছে ১১/১২ বছর বয়সের ছোট্ট ছেলে নয়ন (ছদ্মনাম)।

কয়েক বছর আগে অল্প কিছুদিনের জন্য ও আমার ছাত্র ছিল। আমাকে দেখে ও হয়তো কিছুটা সংকোচবোধ করছিলো ও। আমি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম, জিজ্ঞেস করলাম কি অবস্থা, কেমন আছো? বাসার সবাই ভালো তো?
নয়ন: হে ভাই, ভালোই আছে।
আমি: আমাকে মেসে দিয়ে আসো।
নয়ন: উডেন ভাই, উডেন। (উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে আমিই ওকে স্যার না বলে ভাই ডাকতে বলেছিলাম)
আমি: (কিছুদূর যাওয়ার পর) নয়ন পড়াশোনা করো না আর?
নয়ন: না ভাই, করোনার কারণে স্কুল-টিস্কুল বন্ধ ম্যালাদিন। পড়াশোনা ও বন্ধ অইয়া গেছে। স্কুল না থাকলে পড়াশোনা অয়?

উপর্যুক্ত ঘটনাদুটো শুধুমাত্র দুজন কিশোর ছাত্রের ক্ষেত্রেই ঘটেছে বিষয়টি এমন নয়। বরং বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এমন ঘটনা বা চিত্র শত-সহস্র বা তারও অধিক পরিমাণে রয়েছে।

দীর্ঘদিন যাবত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনেকেই স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। অনেকে আবার ক্রমাগত অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। একটি পত্রিকার রিপোর্ট বলছে, ২৫ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী ঝরে পড়েছে। বড় একটা সংখ্যা গেমস, মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর এই আসক্তি কি পরিমাণ ভয়াবহতার দিকে ধাবিত হচ্ছে তা চাঁদপুরের মতলবে গেমস খেলতে এমবি কেনার টাকা না দেওয়ায় স্কুল ছাত্রের আত্মহত্যা, গেমস খেলতে না দেওয়ায় বগুড়ার স্কুল ছাত্রীর আত্মহত্যার নিউজগুলো পড়লেই উপলব্ধি করা যায়।

আরো ভয়ানক অশনিসংকেত হচ্ছে অনেকে মাদকাসক্তও হয়ে যাচ্ছে। অবস্থা কতটা ভয়াবহতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে নিসঃন্দেহে তা অনুমেয়। আমাদের দেশে বাজার, শপিংমল, ফেরিঘাটসহ অন্যান্য সবই চলছে কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু বন্ধ। অবস্থাটা এমন যে করোনাভাইরাসের বিরোধ শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথেই?

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি সময় বন্ধ বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। (তথ্যসূত্র :ইউনিসেফ) পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এতো দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে কিনা জানা নেই। এমনিতেই আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা আশাহত হওয়ার মতো।

তার মাঝে এভাবে এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিক্ষা নামক জাতির মেরুদণ্ড অচিরেই এমনভাবে ভেঙে যাবে যে আদৌ আর দাড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ। দ্রুততম সময়ে এই সমস্যার সমাধান করতে না পারলে ভবিষ্যত প্রজন্ম শুধু নয় বরং এদেশের ভবিষ্যত অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।

তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত দাবী এই যে যথাযথ স্বাস্থ্য বিধি মেনে অনতিবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শিক্ষা নামক জাতির মেরুদণ্ডকে রক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া