বুক রিভিউ

বার্ধক্যে বসবাস: অন্তিম জীবনের মর্মান্তিক গল্প

বার্ধক্যে বসবাস
লেখক ও বইয়ের প্রচ্ছদ

মানুষ বার্ধক্যে শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। এসব সমস্যার কারনে পরিবারগুলোতে দুশ্চিন্তায় কাটাতে হয় সদস্যদের। বিশেষ করে মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে সবার মাঝে বড় ধরণের লজ্জা কাজ করে। এসময় বার্ধক্যে উপনীত ব্যক্তিরা ভোগেন বেশ কয়েকটি সমস্যায়। বিশেষ করে ডিপ্রেশান, ডিলিরিয়াম, আলঝেইমার এবং ডিমেনশিয়া অন্যতম।

বার্ধক্যে উদ্ভুত এসব সমস্যা এবং সেসময়ে করণীয় নিয়ে গবেষণাধর্মী বই ‘বার্ধক্যে বসবাস’। বইটির রচয়িতা ড. মাসুম আহমেদ পাটওয়ারী। মানুষ যখন গবেষণাধর্মী বই পড়তে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়না ঠিক সে সময়ে গল্পের ছলে বুঝানোর মত বাংলা সাহিত্য জগতে নতুন একটি ধারা চালু করার চেষ্টা করেছেন লেখক।  বিভিন্ন গল্প এবং বাস্তবতার সাথে মিল রেখে যেভাবে বইটি লেখা হয়েছে তাতে গবেষণাধর্মী এসব বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ আরও বাড়বে।

বাংলা সাহিত্যজগতে শেষ বয়সের বার্ধক্যজনিত এসব সমস্যা নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি নেই বললেই চলে। লেখক মূলত গবেষণাধর্মী এই বইটি বার্ধক্যে বসবাসরত মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই লিখেছেন। নানান উপমার মাধ্যমে বার্ধক্যে উদ্ভুত বিভিন্ন সমস্যা এবং তার সমাধানের উপায় পাঠক হৃদয়ে সাড়া জাগাবে বলে মনে করি।  

পরিবেশগত স্বাস্থ্য নিয়ে অনেকদিন কাজ করেছেন ড. মাসুম আহমেদ পাটওয়ারী। বার্ধক্যজনিত রোগ নিয়ে তার জীবনের বাস্তবতা এবং গবেষণা থেকে তিনি কিছু তত্ত্ব দাঁড় করেছেন। সত্য ঘটনা অবলম্বনে তার নিজের দেখা বার্ধক্যে বসবাস করা অর্থে সন্তানে সফল কিন্তু মানবিকভাবে ভীষণরকম একাকী মানুষদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ‘বার্ধক্যে বসবাস’ বইটি। আলঝেইমার, ডিমেনশিয়া যা অস্বস্তিকর, লজ্জাজনক এবং বিব্রতকরও বটে। বাংলাদেশে মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যেখানে পাগল বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে সেখানে এই রোগ সম্পর্কে খুব সাবলীলভাবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন লেখক।

বইটি মূলত তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথমত, দেশ ও বিদেশের কথা। যেখানে লেখক নিজ দেশ এবং বিদেশের কিছু মানুষের মধ্যে ঘটে যাওয়া সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। খুব সুন্দর এবং সাবলীল ভাষায় কয়েকটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করেছেন যা পাঠকের হৃদয়ে লাগার মতো।

দ্বিতীয়ত, বিষয়ের গভীরে। যেখানে বার্ধক্যে উদ্ভুত সমস্যাগুলোর বিভিন্ন অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মানুষের ব্রেইন ফাংশন বা মস্তিষ্কের কার্যক্রম এবং এর অঞ্চল নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বার্ধক্যে একজন মানুষের কী কী রোগ হয় যা আমরা সহজে বুঝতে পারি না সে সম্পর্কেও বিশদ আলোচনা রয়েছে বইটিতে। এ অধ্যায়ে বার্ধক্যজনিত রোগ ডিপ্রেশান, ডিলিরিয়াম এবং আলঝেইমার নিয়ে গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়েছে। এসব রোগের লক্ষণ এবং কারণসমূহের বিশদ আলোচনা করা হয়েছে অধ্যায়টিতে।

তৃতীয়ত, কর্মে ও অভিজ্ঞতায়। এই পর্বে লেখক তার জীবনে পিএইচডি গবেষণার একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র  ক্যালিফোর্নিয়ার বৃদ্ধাশ্রম থেকে প্রাপ্ত ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে লেখকের দায়িত্বে থাকা একজন রোগীর আদ্যোপান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। অধ্যায়টিতে বিল নামের এক ভদ্রলোকের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে যিনি আলঝেইমারে আক্রান্ত। বিল আলঝেইমারে আক্রান্ত হলেও তিনি যে পরবর্তিতে ডিমেনশিয়া আক্রান্তের প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলেন তার আচরণবিধি এবং কথা বার্তা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই ব্যক্তির সাথে কাটানো সময়, তার অভিব্যক্তি অনুধাবন করে তাকে বুঝার যে কৌশল লেখক উল্লেখ করেছেন তা বেশ চমৎকার। তবে তৃতীয় অংশটি যেমন ছিল মর্মাহত গল্প, তেমনই শিক্ষণীয় বটে।

বইটি পড়ার পর একজন পাঠক ডিপ্রেশান, ডিলিরিয়াম এবং আলঝেইমারের যে ধরণ, লক্ষণ এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও কৌশল সে সম্পর্কে জানতে পারবে খুব সহজেই। আমাদের পরিবারের বার্ধক্যে উপনীত হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে আমরা যেভাবে ভয় পাই বা অনেক সময় তাদের নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি বা তাদের উপর বিরক্ত হই এ বইটি পড়লে সে জায়গাটা খুব সহজেই সংশোধন হবে বলে অনুমেয়। বইটিতে বিশেষত সকল ধর্মের পবিত্র বাণীগুলো স্থান পেয়েছে। বার্ধক্য সম্পর্কিত বিভিন্ন ধর্মীয় জ্ঞানের উদ্ধৃতি অসাধারণ অনুভুতির সৃষ্টি করে।

বিজ্ঞান এবং ধর্মীয় তথ্যে বইটি আরও শিক্ষণীয় এবং উপজীব্য হয়ে উঠেছে। পবিত্র কুরআন, বাইবেলসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত বিশেষ আয়াত বা বাক্য দিয়ে পাঠকের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করা হয়েছে। যা পড়ার পর একজন মানুষ সমাজ, ধর্ম এবং বৃদ্ধ বাবা মায়ের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হবেন। ডিপ্রেশান, ডিলিরিয়াম এবং আলঝেইমার রোগীদের প্রতি যে শ্রদ্ধাশীল আচরণ প্রয়োজন তা এই বই থেকে খুব সহজেই শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। অল্প কথায় বইটি সম্পর্কে আসলে খুব বেশি বুঝিয়ে শেষ করা যাবেনা। বইপ্রেমী পাঠকদের উচিৎ বার্ধক্যের বিষয়গুলো জানার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাধর্মী এই বই পড়া। ভালো থাকুক বার্ধক্যে বসবাসরত আশেপাশের মানুষগুলো।

লেখকের কথার সাথে মিল রেখে বলতে চাই, “মানুষের জীবন, ছুটে চলা জীবন। সব প্রাণী ছুটে চলে দেহে। একমাত্র মানুষ ছুটে চলে দেহে ও মনে একসাথে। এই ছুটে চলা যদি একসাথে না হয়, তাহলে কোনকিছুর সন্তুষ্টি আসেনা। পরিপূর্ণ ফল পাওয়া যায় না।”