‘ভাইরাল’ হলেই বিচার নিশ্চিত!

মতামত
লেখক

‘ভাইরাল’ বর্তমান সময়ের একটি আলোচিত শব্দ। ঘটে যাওয়া কোন ভালো অথবা খারাপ ভিডিও, ছবি কিংবা কোন পোস্ট যখন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে যখন ছড়িয়ে দেন এবং এটি টক অব দ্য কান্ট্রি কিংবা ওয়ার্ল্ড হয় তখন এটিকে ভাইরাল বলা হয়।

সুবিধা হলো ভাইরাল হওয়া বিষয়টি মানুষ মুহুর্তের মধ্যে জেনে যায় এবং প্রসংশা অথবা প্রতিবাদের ঝড় উঠে যায়।

তবে বাংলাদেশে ইতিবাচক বিষয়ের চেয়ে নেতিবাচক বিষয়ই ভাইরাল সাধারণত বেশি হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক অন্যায় তথা সবল কর্তৃক দূর্বলের উপর নির্যাতনের ঘটনাই বেশি। ভাইরালের আশীর্বাদে বিচার পান নির্যাতিত ব্যক্তি। 

পদ্মার স্পীড বোটের দূর্ঘটনায় ২৬ জন মারা গেছে। ১০ জনের ধারণ ক্ষমতার এই অবৈধ যানটিতে ৩০ জন যাত্রী নেয়া হয়েছিলো। স্পীড বোট মালিকদের ভাগ্য ভালো এ ঘটনার কোন ভিডিও নেই। ভাইরাল হওয়ার আর সুযোগ কোথায়। ফলে এই স্পীড বোটগুলো আগের মতোই চলছে। দূর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই গেলো। যদিও প্রায় প্রতিদিনই দূর্ঘটনার শিকার হতে হয় যাত্রীদের।

কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন, নৌ-মন্ত্রণালয় এবং সরকারের অন্য সব বডিগুলো নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকছেন বছরের পর বছর। তবে হ্যাঁ এ্যাকশন হবে যদি নিকট ভবিষ্যতে কোন দূর্ঘটনা ঘটে এবং তা ভাইরাল হয়। 

মঙ্গলবার (৫ মে) রাজধানীর বংশালে সুলতান নামক এক ভদ্রলোক (মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি পড়নে পাঞ্জাবি) একজন নিরীহ রিক্সাওয়ালাকে সামান্য কারণেই মারধর করে। রিক্সাওয়ালা এক পর্যায়ে বেহুশ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। 

উপস্থিত জনতা সুলতান সাহেবকে কিছুই বলতে পারেন নি। কারণ তিনি স্থানীয় লোক এবং প্রভাবশালী। আবার কপালে নামাজ পড়ার দাগও বিদ্যমান। সব কিছু মিলিয়ে জনতার রোষানলে পড়তে হয়নি তাকে। ঘটনা আপাত দৃষ্টিতে ওখানেই শেষ এবং সুলতান সাহেব নিরাপদে বাড়ি ফিরে গেলেন। রাস্তার কিছু বিবেকবান মানুষদের পরিচর্যায় বেচারা রিক্সাওয়ালা জ্ঞান ফিরেছিলো এবং তিনি ব্যথাতুর শরীর এবং মন নিয়ে প্রস্থান করলেন। 

তিনি ধরেই নিয়েছেন যে এটাই তার নিয়তি। কে জানে সারা জীবনে হয়তো এরকম ঘটনা অনেকবারই ঘটেছে। তাই হয়তো সহ্য ক্ষমতা তৈরি হয়েছে এমনিতেই। করোনাভাইরাসের এন্টিবডির মতো। 

ঘটনাস্থলে নিশ্চয়ই সেখানকার কাউন্সিলরের লোক, বাজার কমিটির নেতা কিংবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনেক সদস্যই ছিলেন। কিন্তু নিরুপায় রিক্সাওয়ালাকে বিচারহীনভাবেই চলে যেতে হয়েছে।

সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়। একজন টিভি সাংবাদিক সে সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তার কাছে বড় ক্যামেরা ছিলো। কৌতুহলবশত তিনি ভিডিওটি ধারণ করেন। বড় ধরণের কোন ঘটনা না ঘটলে বেচারার গালে সামান্য কয়টা চর থাপ্পরের নিউজ টিভিতে সাধারণত আসার কথা না। এবং আসেও নি।

কিন্তু বেচারার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়ার দৃশ্যটি একটু হৃদয়বিদারক।

সাংবাদিক মনে ব্যথা পান এবং ভিডিওটি ফেসবুক এবং ইউটিউবে ছেড়ে দেন। অবশ্য সাংবাদিক না হয়ে অন্য কেউ ভিডিওটি করলে তাই করতেন।

মুহুর্তের মধ্যেই সারাদেশের কোটি কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে যায় এই ভয়ংন্কর দৃশ্য

ভাইরাল হয়ে যায় ভিডিওটি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশে জনাব সুলতান সাহেবকে আটক করা হয়। সম্ভবত উত্তম মধ্যম কিছু দিয়েছেও পুলিশ।

এটি প্রতিদিনকার ঘটে যাওয়া কয়েক হাজার ঘটনার একটি। বেচারা রিকসাওয়ালা তার নির্যাতনের দৃশ্যটি ভাইরাল হওয়ায় কিছুটা হলেও বিচার পেয়েছেন। 

এই লোকটিই যদি নির্যাতনের পর থানায় এসে অভিযোগ দিতেন তাহলে কি হতো? সুলতান কি আটক হতেন। সম্ভাবনা ছিলো খুবই কম। হয় পুলিশ তাকে পাত্তাই দিতো না, তার অভিযোগ আমলে নিতেন না অথবা স্থানীয়দের চাপে কিংবা নেগোসিয়েশনে বিষয়টির কবর রচনা হতো। 

আশার দিক হলো এ পর্যন্ত যতগুলো ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সবকটিরই বিচারই হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে শর্ত হলো ভিডিওটি নৃশংস হতে হবে। 

যদি হালকা মারধরের ঘটনা হয় তাহলে কিন্তু এটি ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ নেটিজেনরাও ধরেই নিয়েছেন দু চারটা চর থাপ্পর অপেক্ষাকৃত দূর্বল এবং গরীব লোকদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তাই ভাইরাল হতে হলেও মাইর একটু বেশিই হতে হবে। মাইর যখন নিশ্চিত তখন নির্যাতনকারী বাহাদুরকে অনুরোধ করে গাছের সঙ্গে বাঁধা কিংবা যে উপায়ে প্রহার করলে নেটিজেনদেরও চোখে লাগে সেটি নিশ্চিত করা। তাহলে কোন প্রকার হয়রানি ছাড়াই বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। 

তবে সেখানেও একজন সাহসী লোক দরকার হবে যিনি কৌশলে ভিডিওটি করে ফেসবুকে ছেড়ে দিবেন। সেক্ষেত্রে ঝামেলা হলো নেটের প্যাকেজের দাম বেশি হলে ভিডিওকারী এটি পোস্ট করতে পারবেন না। 

আর যেসব ঘটনা ভাইরাল হয় না সেগুলোর বিচার তো হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং অনেকাংশে ভিকটিমকেই দোষারোপ করে দ্বিতীয়বার শাস্তি দেয়া হয়। 

কারণ হলো, অত্যাচারিত অত্যাচারির চেয়ে কম বলবান। ভিকটিম ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য নানান জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। খরচ করতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এমনকি বেশিরভাগ থানায় জিডি করতেও ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা দিতে হয়। এরপর শুরু হয় অন্য দেনদরবার। নির্যাতনকারী যদি ১০ হাজার টাকা খরচ করে তাহলে নির্যাতিতকেও সমপরিমান টাকা খরচ করতে হয় ন্যায় বিচারের জন্য।

ইউনিয়নের মেম্বার, চেয়ারম্যানদের বড় একটি অংশ টাকা ছাড়া কোন সালিশে অংশগ্রহনই করেন না। এমনকি দু পক্ষ থেকেই টাকা নিয়ে থাকেন। আবার এক শ্রেণির লোক আছে যাদের পেশাই সাশিশ করা। তারাও বাদী এবং বিবাদী উভয়ের কাছ থেকেই সুবিধা গ্রহণ করে থাকেন। 

এমনকি অন্যদের সাথে সাথে স্থানীয় বেশিরভাগ সাংবাদিককেও দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। কেননা উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকদেরকে সামান্য কটি পত্রিকা কিছু সম্মানী দিয়ে থাকেন। তবে তা যৎসামান্য। 
বরং অনেকে বিভিন্নবাবে উপার্জিত টাকা তাদের অফিসেও পাঠাতে হয়।

এটাই বর্তমান সমাজের বাস্তব চিত্র। তবে ব্যতিক্রমও আছে। কিন্তু সংখ্যাটা নিতান্তই কম। 

আর এ কারণেই বেশিরভাগ নির্যাতনের শিকার মানুষ বিচারের আশাই ছেড়ে দেন। এবং এটাই তাদের নিয়তি বলে ধরে নেন। 

আর এদেশের মানুষের একটি বদ এবং ভয়ঙ্কর অভ্যাস হলো কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা। বিপরীত পক্ষের শরীরে একটু শক্তি কম অনুভূত হলে কিংবা সমাজে কম প্রতিপত্তি থাকলে অথবা গরীব হলে আর কোন কথা নেই। হাতেই সব কাজের সমাধান হয়ে যায়। ইদানীংকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যদের কিছু অংশকে কথায় কথায় নাগরিকের গায়ে হাত তুলতে দেখা যায়। এটিও ভাইরালের আাশীর্বাদেই। এমন একটি অসভ্য দেশ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। 

এগুলো কেন হচ্ছে? মানুষ কেন বিচার পাচ্ছে না কিংবা বিচারের জন্য টাকা পয়সা খরচ সহ কেন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এমন কোন বেসিক গবেষণা দেশে নেই। এখন চলছে ২০০ কিংবা ৫০০ লোকের মধ্যে জরিপ করে ২০ কোটি মানুষের সম্পর্কে আন্দাজে কিছু একটা বলে দেয়া। 

তবে মোটা দাগে বলা যায় সমাজে সুশিক্ষার অভাব এবং সুশাসনের অভাবে এমনটি হচ্ছে। সমাজে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।

অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পিলার হলো সামাজিক ন্যায় বিচার। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সামাজিক ন্যায় বিচারের চিত্র ভয়াবহ। 

তবে জুকারবার্গকে ধন্যবাদ জানাতে হয় কারণ তিনি ফেসবুকটি তৈরি না করলে এবং এদেশের ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণের ভার কোন দেশীয় সংস্থার নিকট অর্পণ করলে ফলাফল হতো ভিন্ন। যে কটি লোক বিচার পাচ্ছে তারাও হয়তো অন্য সবার মতো সহ্য ক্ষমতা বাড়াতে হতো।

তবে জুকারবার্গের প্রতি আহ্বান থাকবে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়া বন্ধ করবেন না প্লিজ। 

আপনি ভাইরাল হওয়ার সুযোগ দেয়ার কারণে কিছু লোক ভয়ে অত্যাচারের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। আর করলেও নির্জনে তুলে নিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে কার্যসম্পাদন করে থাকেন। 

আর যাদেরটা ভাইরাল হয় তারাতো সোনার চামুচ মুখে দিয়ে এদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। তারা নিশ্চয়ই সৌভাগ্যবানদের অন্যতম। কারণ তারা নির্যাতনের বিচার পাচ্ছেন স্ব সম্মানে এবং কোন ঝামেলা ছাড়া। 

তাই জুকারবার্গের কাছে এদেশের নৃশংসভাবে নির্যাতিত ভাইরাল হওয়া মানুষ চির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তয় ভাই এই ভিডিওর মধ্যে আবার বিজ্ঞাপন ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে পারে এদেশের নির্যাতনকারী সমিতির সদস্যরা। এরকম কিছু হলে ভাইরাল হলেও কিন্তু আর লাভ হবে না। 

সবশেষে আমি আশাবাদী। আমার দেশের সমাজের রক্ষকরা নিশ্চয়ই তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবেন। ছোট বড় সকল অপরাধেরই বিচার হবে। ভাইরাল হওয়ার উপর নির্ভর করা লাগবে না। 

এমন একটি দিনের অপেক্ষায়ই রইলাম।

লেখক: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, দ্য বিজনেস স্যান্ডার্ড ও সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি