গণমাধ্যম কারো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারে না

গণমাধ্যম
উল্টোপথে চলছে দেশের মিডিয়া

মিডিয়া নিরেপক্ষভাবে এবং বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রেখে সংবাদ পরিবেশন করবেন বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সকল মিডিয়াই বলে থাকেন তারা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেন। কিন্তু বর্তমানে কিছু কিছু মিডিয়ার ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে রীতিমতো ঝড় চলছে।

আপনি যখন পত্রিকা চালাতে জনগণের ট্যাক্সের টাকার সুবিধা নিবেন, বস্তুনিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ থাকবেন বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তখন আপনাকে অবশ্যই এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে পত্রিকাটি যদি দলীয় মুখপাত্র হয়, দলের টাকায় চলে তাহলে ভিন্ন কথা। আপনি আপনার গতিতে চলবেন। কারণ গণমাধ্যম এবং মুখপাত্র দুটো ভিন্ন বিষয়।

কিন্তু দেশের বেশকিছু মিডিয়া অনেকদিন ধরে চলছে উল্টোপথে। কিছু মিডিয়া সত্যিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। অনেক মিডিয়া আবার বিভিন্ন দলের দালালি কিংবা দলকে ক্ষমতায় রাখা কিংবা ক্ষমতায় আনার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিছু সাংবাদিকও প্রকাশ্যে নানান দলের দালালের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে। যেটি দেশের বোদ্ধা সমাজ এমনকি সাধারণ মানুষেরও দৃষ্টিগোচর হয়েছে। 

গণমাধ্যমের কাজ হলো কোন ঘটে যাওয়া ঘটনাকে সঠিকভাবে তুলে ধরা। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাও ঠিক তাই। কারো প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে প্রকৃত চিত্র জনগণকে জানানো। পাঠক বিষয়টি জানবেন, প্রতিক্রিয়া জানাবেন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি দপ্তর নিউজের প্রেক্ষিতে  ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

কোন মিডিয়া পথভ্রষ্ট হলে জাতীয় প্রেস কাউন্সিল এর বিচার-বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নিবেন। কিন্তু আফসোস এমন একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও এর কাজকর্ম কয়েকটি  ট্রেনিং এবং সামান্য কয়েকটা পুরষ্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। 

আবার কোন মিডিয়ার সার্কুলেশন কেমন, নিয়মিত বের হয় কিনা তা দেখার দায়িত্ব ডিএফপি নামক রাষ্টীয় একটি প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু শত শত পত্রিকা মাসের পর মাস বের না হয়েও ১০ হাজার থেকে ১ লাখের বেশি কপির সুবিধা নেয়। কেউ কেউ আবার প্রতিদিন ১০ হাজার ছাপিয়ে লাখ লাখ কপি ছাপানোরও সকল সুবিধাদি গ্রহণ করেন।

নবম ওয়েজ বোর্ড কার্যকর করা কথা থাকলে কয়েকটা পত্রিকা অষ্টম ওয়েজবোর্ড কার্যকর করেছে। দেশের শীর্ষ পত্রিকার বেশ কয়েকটি সহ প্রায় সকল পত্রিকাই চলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে। এসব পত্রিকার সাংবাদিকরা সত্যিকার অর্থেই মানবেতর জীবনযাপন করেন। চাঁদাবাজ কিংবা ব্ল্যাকমেইল করে যারা চলেন তাদের কথা অবশ্য ভিন্ন। 

অনলাইন মিডিয়ার আবির্ভাব আরো একটি সর্বনাশের মূল। লাখ লাখ অনলাইন পোর্টাল খোলা হয়েছে। নেই কোন তদারকি। নাই নীতিমালা। পৃথিবীতে এমন ঘটনা সত্যিই বিরল। অনভিপ্রেত বিষয় হলো এ পোর্টালগুলো বেশিরভাগ অপেশাদার এবং ধান্ধাবাজদের হাতে। ফলে এমন কিছু নিউজ দেখা যায় যেটা কোনকালেই গণমাধ্যমের সাথে যায় না। এরা আবার দেশের ওয়ার্ড পর্যায়ে পর্যন্ত কার্ড বিলি করে। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসব সাংবাদিকদের উপস্থিতি সারাদেশে লক্ষ্যনীয়। ২০ টাকা থেকে শুরু হয় তাদের দেন দরবার।

এরা আবার অনলাইন মিডিয়ার নামে জাতীয় সংগঠনও খুলে বসেন টেকনাফ থেকে কিংবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন একটি এলাকা থেকে। এরা নিউজের ইনট্রো পর্যন্ত ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারে না। এদের কেউ কেউ স্থানীয়ভাবে ইয়াবার ব্যবসাও করে থাকেন। সেলুনের নাপিত থেকে শুরু করে ভ্যানওয়ালার কাছেও এখন মিডিয়ার কার্ড পাওয়া যায়।

আবার অনেক আঞ্চলিক পত্রিকা কার্ড দেয়ার বিনিময়ে তথাকথিত রিপোর্টারের কাছ থেকে প্রতিমাসে ন্যুনতম ৫০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন। কার্ডধারী স্থানীয়ভাবে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং বিভিন্ন সংগঠনের নেতা বনে যান। নানান রকম ধান্ধা ফিকির করেন এর মাধ্যমে।

অসহায় সাধারণ মানুষ অনেকাংশে অনেক ভিআইপিও এদের খপ্পরে পড়তে বাধ্য হন। মজার বিষয় হলো এ মাপের সাংবাদিকের সাথে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সাথে সম্পর্কও চমৎকার। এরা একে অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।

এবার আসি বড় বড় পত্রিকার প্রভাবশালী এবং শিক্ষিত সাংবাদিকদের কথায়। বিশ্বাস করুন বড় পত্রিকাগুলোর বেশিরভাগ সাংবাদিক সঠিক পথে আছেন অথবা প্রকৃত সাংবাদিকতা করতে চান। বাংলাদেশ আজ যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তাতে সাংবাদিকদের অবদান অনেক। সাংবাদিকরা সঠিক তথ্য তুলে ধরার ফলে অনেক দুর্নীতি কমেছে। ভয়ে থাকে দুর্নীতিবাজরা। এ কারণে অনেক সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে আবার অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। বিচার সেতো নীরবে নিভৃতে কাঁদে।

তবে এটা সত্যি দেশে আজ অনেক মিডিয়া। বেশিরভাগই মালিকদের সেফগার্ড হিসেবে কাজ করছে। লাগামহীন এ মিডিয়ায় মেরুদন্ড আছে এমন সম্পাদক কিংবা বড় সাংবাদিকের সংখ্যা খুবই কম। সাংবাদিকরা শুধুই চাকুরিজীবী এখানে। আগেই বলেছি কোন গ্রুপ যদি তার নিজস্ব টাকায় পত্রিকা চালায় তাহলে সে যেভাবে ইচ্ছা পত্রিকা প্রকাশ করুক, যা ইচ্ছা তা লিখুক। কেউ অন্যায়ের শিকার হলে আদালতে যাবে। আবার সরকারের সমালোচনা না করে দালালীও করতে দেখা যায় হরহামেশ।

কিন্তু জনগণের ট্যাক্সের টাকার বিজ্ঞাপনে পরিচালিত কোন পত্রিকা গ্রুপের কথায় মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিংবা কারো এজেন্ডা বাস্তবায়নে সংবাদ প্রকাশ করতে পারে না। তাকে অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটিই প্রকাশ করতে হবে এবং সে বাধ্য। এমন নিরপেক্ষভাবে সরকারী সকল কর্মচারীরও কাজ করার কথা। কিন্তু কি দেখছি আমরা। বেশি বললে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রেহাই দিবে না নিশ্চয়ই।

বাংলাদেশের পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়ার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে কুমিল্লার মেয়েটির মৃত্যুবরণের পর (আত্মহত্যা অথবা হত্যা)। কয়েকটি মিডিয়া নিউজ করেনি আবার কয়েকটি সাংবাদিকতা ইথিকসে যায় না এমন সংবাদ পরিবেশন করেছে। যা তারা করতে পারে না। কারণ ওই সবগুলো পত্রিকায় জনগণের টাকার মোটা অংকের বিজ্ঞাপন যায়। কিন্তু করছে। করে যাচ্ছে অন্যসব ঘটনার ক্ষেত্রেও।

এমন পক্ষপাতদুষ্ট এবং অপ সাংবাদিকতার বিপক্ষে মুখ খুলেছেন পাঠক এবং আপামর জনসাধারণ। ফেসবুকে কিংবা স্যোসাল মিডিয়ায় সাংবাদিকতার নামে কি কি হচ্ছে তাও প্রকাশ করে দিচ্ছে। ঢালাওভাবেও মন্তব্য করা হচ্ছে। পাঠক কিংবা জনগণের মত প্রকাশের অধিকারও আছে বটে। তবে তাদের বক্তব্য সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ এদের একটি অংশ হেফাজতের যে কোন নিউজ ছাপালে খুশি আবার একটি অংশ চায় না হেফাজতের বিরুদ্ধে যায় এমন কোন নিউজ ছাপানো হোক।

তবে সকল মিডিয়া যদি সঠিক তথ্যটি এবং এথিকস মেনে তুলে ধরতো তাহলে দিন শেষে মিডিয়ারই জয় হতো। কিন্তু আসলে মিডিয়া কি সেটা করতে পেরেছে। প্রায় প্রতিটি মিডিয়া হাউজেই কিছু দালাল থাকে যারা একেক গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। এদেরকে নির্মূল করতে হবে আগে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টিটা কে বাজাবে?

মনে রাখতে হবে গণমাধ্যম গণমানুষের জন্য। তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় কিংবা পত্রিকা না পড়ে, টেলিভিশন না দেখে তাহলে মিডিয়ার কিছুইতো আর থাকবে না।

একইসঙ্গে যুগোপযোগী এবং মানসম্মত পরিবেশনা না থাকলে মিডিয়া দারুণ হুমকির মুখে পড়ে যাবে যেটি মিডিয়ারতো বটেই জাতির জন্যও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। দেশ দুবৃত্তদের হাতে চলে যাবে।

সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগঠনগুলো আজ নানান ভাগে বিভক্ত। আদর্শিক কারণের চেয়ে ভাগ বাটোয়ারা সমস্যাই বেশি এখানে। অজানা কারণে তারা সবকিছু জেনেও পত্রিকার মালিক এবং অন্যদের সাথেই তাল মিলিয়ে চলেন। ফলে উপেক্ষিত হয় সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিকদের অধিকার। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশ।

এখনো ভাবার সময় আছে। মিডিয়াকে সত্যিকারের গণমানুষের প্রচার মাধ্যমে পরিণত করতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ  সংবাদটিই মানুষকে জানাতে হবে। আদর্শ, রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, স্বার্থ, এজেন্ডা সকল কিছু ঝেড়ে মিডিয়ারুমে ঢুকতে হবে। গণমাধ্যম আবার প্রসংশা পাবে সে অপেক্ষায় রইলাম। 

সম্পাদক, সাংবাদিক নেতা, রিপোর্টার, সাব-এডিটররা আবার ঐক্যবদ্ধ হবে। অভিনয়, ভণিতা না করে সত্যিকার অর্থেই দেশপ্রেমিক হিসেবে দেশের জন্য কাজ করবে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, দ্য বিজনেস স্যান্ডার্ড ও সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি