প্রাজ্ঞদের শূন্যতায় পরিপূরক তৈরি হচ্ছে কি?

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক চেতনার উৎকর্ষতায় নীতি প্রণয়নে সহায়তা প্রদান। দেশীয়-আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিবিড় গবেষণা থেকে শুরু করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান। জাতির নানা ক্রান্তিকালে প্রবন্ধে-নিবন্ধে পরামর্শ দিয়ে পথ দেখানো। প্রয়োজনে রাজপথে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা কিংবা প্রতিবাদ। নিষ্ঠার সঙ্গে এ কাজগুলো করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাজ্ঞ শিক্ষকরা। তবে গত কয়েক বছরে এমন অনেক প্রাজ্ঞজন হারিয়েছে বাংলাদেশ। অবসরজনিত শূন্যতার পাশাপাশি অসুস্থতার কারণে খ্যাতিমান শিক্ষকদের একাংশ শিক্ষকতা পেশায় এখন আর সক্রিয় নেই। এখন প্রশ্ন উঠছে দেশের উচ্চশিক্ষায় প্রাজ্ঞজনদের এ শূন্যতায় পরিপূরক তৈরি হচ্ছে কী?

বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে যেসব জ্যৈষ্ঠ অধ্যাপকগণ অবসরে যাচ্ছেন, তাদের সকলেই ছিলেন একেক জন পরিপূর্ণ শিক্ষক। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে সত্তরের দশকের শুরু পর্যন্ত তৎকালীন যেসব শিক্ষকদের উত্থান হয়েছিল এমন একটি সময়ে ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মতো উৎকৃষ্ট সময়ে তাদের বেড়ে ওঠা। এদের সকলেই দেশাত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। একটি উন্নত সমাজ বিনির্মাণে নিয়ামক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে উন্নত মানুষে পরিণত হওয়ার অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে শিক্ষক সমাজের মানবিক ও নৈতিক শিক্ষায় একাগ্রতা ও আগ্রহ কম। এরফলে এক ধরনের মানবিক সংকট তৈরির ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রধান কাজ হলো গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও শিক্ষার্থীদের মাঝে তা বিতরণ করা। এর বাইরে বিভিন্ন গবেষণা মূলক প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও বই লিখে লিখেন। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষক সমাজে গবেষণা বিমুখতা তৈরি হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনীতিকরণের ফলে ও পদায়নের ক্ষেত্রে প্রকাশনাকে গুরুত্ব না দেয়ার ফলে শিক্ষকরা মৌলিক কাজ থেকে দূরে রয়েছে। এছাড়া শিক্ষকতা যে একটা আলাদা পেশা তা অনেক শিক্ষকই ভুলে গেছে। বেশির ভাগ শিক্ষকই শিক্ষকতাকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছেন।

গেল কয়েক বছরে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠটি থেকে অবসরে গেছেন বেশ কয়েকজন গুণী ব্যক্তিত্ব। এদের মধ্যে রয়েছেন দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম, বাংলা বিভাগের অনারারি অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম ফজলুল হক, ফার্মেসী বিভাগের ইমিরটোস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ইতিহাস বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথিতযশা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গত বছর প্রয়াত হয়েছেন। একইভাবে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর ও বুয়েটসহ দেশের পুরানো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক প্রাজ্ঞ শিক্ষক অবসরে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছেন।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, যদি কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করে যে এ মুহূর্তে দেশের উচ্চশিক্ষায় প্রধান সমস্যা কি? আমি বলব ভালো মানের শিক্ষকের অভাব। কেননা একটা সময় ছিল ভালো ফলাফল অর্জনকারী সর্বোচ্চ মেধাবীদের বেশিরভাগই শিক্ষকতা পেশায় আসতেন। এখন উচ্চশিক্ষার প্রসার হলেও দুর্ভাগ্যক্রমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আগের মতো মানসম্মত শিক্ষক তৈরি হচ্ছে না।

তিনি বলেন, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মেধাবীদের আমরা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে পারছি না। আবার যারা আসছেন তাদেরও ধরে রাখতে পারছি না। একটা জাতির উন্নয়নে শিক্ষক সমাজের প্রয়োজনীয়তা। তাই টেকসই জাতীয় উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে আমাদের উচিত ভালো সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করে মানসম্মত শিক্ষক তৈরিতে মনোযোগ দেয়া।