পিএইচডি কী সব?

নাদিম মাহমুদ

পিএইচডি করতে এসে অনেকেই মাঝ পথে ছিটকে যান। প্রথম কয়েক মাস কিংবা বছর পার হওয়ার পর পিএইচডির গবেষণা তার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল মনে করেন। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীও এখানে এসে খেই হারিয়ে ফেলে। অনেকেই শেষ বছরেও পিএইচডি ছেড়ে বাড়ি গেছে। বিষয়টি অদ্ভুত দেখালেও এটিই চিরসত্য।

শারীরিক পরিশ্রমের পাশাপাশি মানসিক চাপ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, পিএইচডি নেওয়ার চেয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখায় কষ্টকর হয়ে পড়ে।

তার কয়েকটি কারণও রয়েছে। ল্যাবের অভ্যন্তরীন পরিবেশ, অধ্যাপকের ব্যবহার, নিদিষ্ট সংখ্যক প্রকাশনার চাপ আর আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে প্রায় প্রতিটি ডক্টরেটধারীদের যেতে হয়। জার্নাল সেমিনার থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক গবেষণার মিটিং যেমন থাকে, তেমনি জুনিয়রদের মেনটরিংও থাকে।

এতো কিছু সহ্য করে যে সামনে এগিয়ে যেতে পারে, তার কাছে পিএইচডি শেষে নবজন্ম মনে হবে। শুধু তার নিজের কাছে নয়, তার পরিবার ও পরিজনের কাছেও তৃপ্তির ঢেকুর মনে হবে।

কিন্তু পিএইচডি করতে এসে, একবার যদি কারও ল্যাবের অধ্যাপকের সাথে মনমালিন্য তৈরি হয়, তাহলে তার কাছে পিএইচডি মনে হবে একটি জলন্ত কাঠি। উঠতে বসতে তাপ লাগবে, নিজে পুড়বে। অতীতের সব ভাল অর্জন পিএইচডির কাছে তুচ্ছ মনে হবে। হতাশা গ্রাস করবে। মস্তিষ্ককে অকেঁজো করে তুলবে। যে কারণে, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক চিকিৎসার জন্য কাউন্সিলিং ব্যবস্থা করা হয়।

সম্ভবত এমন একটি ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের মারকুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ে। বৃহস্পতিবার নিজের ল্যাবে আত্মহত্যা করেছে অভিজিৎ হীরা নামের এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। চুয়েটের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত এই ছেলে পিএইচডির কাছে নিজের সব অর্জনকে ধুলিসাৎ করে দিল।

হীরার বন্ধুদের দাবি, পিএইচডির চাপ সহ্য করতে না পেরেই সে ল্যাবে গলায় ফাঁস দিয়েছে। আমি জানি না, সে আত্মহত্যা করেছে না স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের শোকবার্তায় স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে, Counseling services and pastoral support are available on campus for all faculty, staff and students. Members of the university’s Counseling Center and Campus Ministry are available.

এটি সত্যি একটি মর্মান্তিক ঘটনা। গবেষণার চাপের কাছে হেরে যাওয়া প্রাণগুলো আমাদের একাডেমিয়ার জন্য লজ্জা। অনেক অধ্যাপকই তাদের শিক্ষার্থীদের ট্রিটমেন্ট দেয় ভুল পন্থায়। মানবিকতা ভুলে যাওয়া এইসব উচ্চ শিক্ষিতদের কাছে হাজারো শিক্ষার্থী জিম্মি। একজন শিক্ষার্থী পিএইচডি করতে গিয়ে যদি ফিরে আসে, তার কাছে সামাজিক চাপটাই মূখ্য হয়ে ওঠে। আমাদের এই চিন্তাধারা থেকে বের হবে। পিএইচডি জীবনের সব নয়। একটা কাগজে সনদ কখনোই নিজের মেধার মূল্যায়ন করতে পারে না। পরিবারের ভালোবাসার মূল্যায়ন করতে পারে না।

যারা সত্যি এই ধরনের চাপে রয়েছেন, তাদের কাছে অনুরোধ দয়া করে আপনার এই সমস্যাগুলো পরিবারের সাথে শেয়ার করুন। অভিজ্ঞ সিনিয়রদের সাথে কথা বলুন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজিক্যাল সেন্টারে গিয়ে কথা বলুন। দেখবেন, নিজের চাপটা হাল্কা হয়ে গেছে। আমরা চাই না, অভিজিৎরা এই কাগজে সনদের কাছে পরাজিত হোক। অমানবিক অধ্যাপকদের কাছে নত হোক। জীবনের রংটাকে উপভোগ করুন।

লেখক: জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণায় নিয়োজিত