ইউজিসির প্রতিবেদন

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সুবিধা নেই ৬৬ ভাগ শিক্ষার্থীর

ঢাবির হলের গণরুমে এভাবে গাদাগাদি করে থাকতে হয় (ডানে)। জাবির হলেও একই অবস্থা (বায়ে)

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব বিদ্যাপীঠে পড়তে আসা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আবার হল জীবনের স্বাদ না পেয়েই অনেককেই শেষ করতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন।

দেশের সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরে সব শিক্ষার্থীও আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোন আবাসনের ব্যবস্থা। তাছাড়া আরও ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা শূন্যের কোটায়।

এসবের মধ্যে একাডেমেক কার্যক্রম চালু না হওয়া, অস্থায়ী ক্যাম্পাসে পাঠদান প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি আররি বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ও।

সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর মাধ্যমে। ফলে প্রশাসন অছাত্র ও বহিরাগতদের বের করতে পারেনা। এতে বৈধ শিক্ষার্থীরা আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ (২০১৯) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৯৫৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আবাসন সুবিধা রয়েছে মাত্র ৯৯ হাজার ৭২৩ জন শিক্ষার্থীর। প্রতিবেদন অনুযায়ী শতকরা ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩টি আবাসিক হল ও ছাত্রাবাস রয়েছে। ১৭ হাজার ৮৬ শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা হলেও অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থীর জন্য কোনো আবাসনের ব্যবস্থা নেই। ৩৮ হাজার ১৭২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৫ শতাংশের নেই কোন আবাসনের ব্যবস্থা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ হাজার ৫৪৪ শিক্ষার্থী থাকলেও আবাসন সুবিধা নেই। প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও প্রশাসন আবাসনের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭টি হল রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৮ হাজার ২৯১ জন শিক্ষার্থী মধ্যে মাত্র ৮ হাজার ৪২২ জন শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৯ শতাংশের নেই কোন আবাসনের ব্যবস্থা।

জাবির হলেও আবাসন সংকট (ফাইল ফটো)

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য শতভাগ আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ হাজার ৬০৮ জন শিক্ষার্থীদের জন্য ১৪টি হল রয়েছে। আর পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ হাজর ৪২৮ শিক্ষার্থীদের জন্য ৮টি হল রয়েছে।

ইউজিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ হাজার ২৮৯ শিক্ষার্থীর জন্য ৩ হাজার ৩৬৯টি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২২ হাজার ৯০২ শিক্ষার্থীর জন্য ৪ হাজার ৯০০টি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ হাজার ১০০ শিক্ষার্থীর জন্য ২ হাজার ২১৭টি, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ হাজার ৫৪৭ শিক্ষার্থীর জন্য ২ হাজার ৯৬৮টি, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ হাজার ৫৮৭ শিক্ষার্থীর জন্য ১ হাজার ৮২টি, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ হাজার ৩৪২ শিক্ষার্থীর জন্য ১ হাজার ৯০৪টি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ হাজার ১০১ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৭৩৮ জন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ হাজার ২৫৮ জন শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র ৪২৮ জন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ হাজার ৪০৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৭৩৮ জনের, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ হাজার ৯৮৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ হাজার ৯৪৭ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন সুবিধা রয়েছে।

আবাসন সংকট, জাককানইবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন (ফাইল ফটো)

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ হাজার ৪১১ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসনের সুযোগ রয়েছে। ৫টি হলে ২ হাজার ৩৬০ শিক্ষার্থীর আবাসনের সুযোগ রয়েছে। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ হাজার ৫৭ শিক্ষার্থীর জন্য ছাত্রদের ৮টি আবাসিক হল রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ হাজার ৫৯৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য আবাসনের সুযোগ রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯২৭ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৪৮ জনের, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ৭৪৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ হাজার ৬৭২ জনের, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ হাজার ৪২৮ জনের মধ্যে ১ হাজার ৯৬ জনের, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ হাজার ৩৭৯ জনের মধ্যে ৩ হাজার ৩৩৮ জনের, চুয়েটে ৫ হাজার ৫৭৮ জনের মধ্যে ৩ হাজার ৮৮০ জনের, রুয়েটে ৪ হাজার ৩৭২ জনের মধ্যে ২ হাজার ৫৭ জনের, কুয়েটে ৫ হাজার ৮৬০ জনের মধ্যে ২ হাজার ৮২৯ জনের, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু) ১ হাজার ২৭০ জনের মধ্যে ১ হাজার ১০ জনের, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ হাজার ১০০ জনের মধ্যে ১ হাজার ৯৫২ জনের, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ হাজার ৯৫৯ জনের মধ্যে ১ হাজার ৩০০ জনের, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ হাজার ৩৯৩ জনের মধ্যে ১ হাজার ৩৯ জনের, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) ৫ হাজার ৪২২ জনের মধ্যে ৩০০ জনের, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ হাজার ৭০২ জনের মধ্যে ৯১৫ জনের, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ হাজার ২৯১ জনের মধ্যে ১ হাজার ৬৩৯ জনের, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৯৯ জনের মধ্যে ১৬৫ জন শিক্ষার্থীর আবাসনের সুযোগ রয়েছে।

যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন ব্যবস্থা শূন্যের কোটায়:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি আররি বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

তবে এদের মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেশের কলেজগুলো ও  ইসলামি আররি বিশ্ববিদ্যালয় ফাযিল-কামিল মাদ্রাসাগুলো এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দূরশিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে সকল স্তরের জনগনের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে।

ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য পড়ালেখার একটা সুষ্ঠু পরিবেশ আর বৈশ্বিক র‍্যাংকিং যেটাই বলুন না কেন আবাসিক ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা এখনো আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারিনি। আবাসন সমস্যা দূরীকরণে ইউজিসিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন খাতে আরো বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান হলগুলোতে যে দখলদারিত্ব, অছাত্র ও বহিরাগতদের অবস্থান তার সমাধান করতে হবে।

এ ব্যাপারে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাবি শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, বিদ্যমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চরম আবাসিক সংকট বিদ্যমান। আবার নতুন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থাপন করা হচ্ছে সেখানে আবাসন ব্যবস্থা মোটেই নিশ্চিত করা হচ্ছে না। ফলে সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। তাই আবাসন সংকট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভূমিকা রাখতে হবে এবং রাষ্ট্রকে আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। আবার আমরা জানি, ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের দখলদারিত্বের কারণে হলগুলোতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর বিরুদ্ধে ছাত্রদের ভূমিকা রাখতে হবে।

ঢাবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ তথা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য আবাসন ব্যবস্থা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ছাত্রদল বরাবরই শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট সমাধানের দাবি জানিয়ে আসছে। আমরা ইতোমধ্যে উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি। পাশাপাশি আমরা এও বলেছি যে হলগুলোতে ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান তথা সুষ্ঠু পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে।