মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ নিয়ে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নয়-ছয়’

নিয়োগ বাণিজ্য
ইসলামি আরবি বিদ্যালয়

প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা উল্লেখ থাকলেও তা অনুসরণ না করেই বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগদানের অভিযোগ উঠেছে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে নিয়োগের বিধি পরিবর্তন ও সংশোধনের অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। যদিও নিয়োগ বিধির ২০ ধারার ক্ষমতাবলে কোটা বাতিল করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।

২০১৭ এবং ২০১৮ সালে দুই দফায় প্রকাশিত ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ২০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘‘কর্তৃপক্ষ কোন কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে আবেদনপত্র, অথবা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল অথবা নিয়োগ কার্যক্রমের আংশিক/সম্পূর্ণ পরিবর্তন/সংশোধন/বাতিল ও পদ সংখ্যা হ্রাস/বৃদ্ধির ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন।’’ তবে কোটা বাতিলের পরিপত্র জারিরর পূর্বে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটার কথা উল্লেখ থাকলে সেটি অনুসরণ করেই নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। যা উপেক্ষা করার অভিযোগ উঠেছে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কোটা সংস্কার করা হলেও কোটা বাতিলের পরিপত্র জারির পূর্বে যে সব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কোটা বাতিলের শর্তটি উল্লেখ করা হয়নি বা নিয়োগ শেষের দিকে ছিল সেখানে নতুন কোটা নীতি প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু যেসব নিয়োগ বিজ্ঞাপনে কোটা বাতিলের কথা উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে নতুন কোটা নীতি অনুসারে নিয়োগ দিতে হবে। তবে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রেখে নিয়োগের কথা উল্লেখ করলেও তা অনুসরণ করেনি কর্তৃপক্ষ। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাদ দিয়েই নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে দুই দফায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ৯ নং ধারায় সরকারি বিধি অনুসরণ করে সকল প্রকার কোটা অনুসরণ করার কথা বলা হলেও তা মানা হয়নি। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। লিখিত পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার জন্য ফলাফল প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। সেই তালিকা অনুযায়ী মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হলেও নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। ফলে বিপাকে পড়েন দেশ স্বাধীন করার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়া জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ছেলে-মেয়েরা।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল ধরনের কোটা অনুসরণ করা হবে। তবে সেটি না করেই নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, তারা নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। মৌখিক পরীক্ষাতেও ভালো করেছেন। তবে অদৃশ্য কারণে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কাউকেই নিয়োগ দেয়নি কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রত্যাশী ভুক্তভোগী গোলাম কিবরিয়া জানান, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার সকল যোগ্যতা থাকার পরও তারা আমাদের নিয়োগ দেয়নি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কাউকেই নিয়োগ দেয়া হয়নি। যখন আমাদের মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয় তখনও কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা সরকার দেইনি। তবুও তারা কোটা বাতিল করেছে। নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতেই এই কারসাজি করেছে কর্তৃপক্ষ।

তিনি আরও বলেন, আমার বাবা দেশ স্বাধীন করার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। অথচ তার সন্তান হয়ে সব যোগ্যতা থাকার পরও শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কারসাজির কারণে আমার চাকরি হয়নি। আমি সব জায়গায় ধরনা দিয়ে আজ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমার মতো আরও ভুক্তভোগী রয়েছেন। তাদেরও একই অবস্থা। আমরা এই বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের অনুরোধ অনুগ্রহ পূর্বক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সাথে ঘটা এই অমানবিক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের নির্দেশ দিন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট এবং ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দুই দফায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। বিজ্ঞপ্তিতে উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, উপ-রেজিস্ট্রার, প্রোগ্রামার, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, সহকারী রেজিস্ট্রার, সহকারী প্রোগ্রামার, এবং সেকশন অফিসারসহ বিভিন্ন পদে ১২২ জনকে নিয়োগ দেয়ার কথা বলা হয়। পরবর্তীতে বিজ্ঞপ্তি দুইটি একিভূত করে ২০১৮ সালের ৭ জুলাই লিখিত পরীক্ষা নেয় কর্তৃপক্ষ। সকল প্রকার কোটা অনুসরণ করে একই মাসের ২০ তারিখে এই সকল পদের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই মাসেরই ২৫ তারিখ থেকে মৌখিক পরীক্ষা নেয়া শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করেই ২৭ জুলাইয়ের পর মৌখিক পরীক্ষা নেয়া স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। প্রায় দুই মাস বন্ধ রাখার পর ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে আবারও মৌখিক পরীক্ষা নেয়া শুরু করে তারা। ১৪ অক্টোবর মৌখিক পরীক্ষার কার্যক্রম শেষ হয়। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪ অক্টোবর সেই বিষয়ে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এদিকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগের দাবিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ বঞ্চিতরা। চিঠিতে তারা বলেছেন,‘‘ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটানীতি অনুসরণ করে লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই থেকে মৌখিক পরীক্ষা শুরু করা হয়। যা কোটা বাতিলের পরিপত্র জারির পূর্বেই সম্পাদিত হয়। যেহেতু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কোটা অনুসরণ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল এবং লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা কোটা বাতিলের পরিপত্র জারির পূর্বেই সম্পাদিত হয়। তাই মোট নিয়োগকৃতেদের মধ্য থেকে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগদানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজিসি সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) প্রফেসর দিল আফরোজা বেগম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অভিযোগ আমাদের দপ্তরে এসেছে। তবে আমাদের হাতে সেই ক্ষমতা নেই যে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি তদন্তে নামতে পারি। আমাদের তদন্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অথবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে জানাতে হবে। এরপর আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পারি।’

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আফতাব হোসেন (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কোটা বাতিলের পরিপত্র জারির পূর্বে যদি কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কোটা অনুসারে নিয়োগের কথা বলা হয়ে থাকে, তবে কোটা মেনেই সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এই বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ইউজিসিকে নির্দেশনা দিব। সেখানে বিষয়টির সত্যতা পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আহসান উল্যাহর ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বছিলা ক্যাম্পাসে গেলে উপাচার্য এ প্রতিবেদককে কোনো সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এ এস মাহমুদের সাথে  যোগাযোগের কথা বলেন।

পরে রেজিস্ট্রার এ এস মাহমুদের দপ্তরে গেলে তিনি জানান, নিয়োগ কার্যক্রমটি যখন সম্পন্ন হয়েছিল, তখন তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন না। তাই এই বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে পারবেন না। তিনি এ প্রতিবেদককে লিখিতভাবে বিষয়টি জানাতে বলেন। পরে ইমেইল করে লিখিতভাবে বিষয়টি জানানো হলে রেজিস্ট্রার এ এস মাহমুদ শীতকালীন ছুটির পর বিষয়টির তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে পাঠানোর কথা জানান। তবে এর পর একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেননি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি তদন্ত করতে ইউজিসিকে নির্দেশ দেয়া হবে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।