এইচএসসিতে ‘অটো পাস’— অভিশাপ না আশীর্বাদ

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীতে অতিষ্ঠ বিশ্ববাসী। এর কালো থাবা থেকে মুক্তি পায়নি বাংলাদেশও। আমি করোনাভাইরাস বা বাংলাদেশের সমসাময়িক বিষয় আলোচনা করার ইচ্ছে বা যোগ্যতা আমার নেই।  আমি আলোচনা করব ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা পরীক্ষার্থী ও শিক্ষাঙ্গনের কথা। 

উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবর্ষ ২০১৮-২০১৯ সালের শিক্ষার্থীদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা গেল পহেলা এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। প্রস্তুতি সেরকমই চলছিল। সোয়া ২ বছর ধরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে প্রস্তুতি নিয়ে প্রস্তুত পরীক্ষার্থীরা, পরীক্ষা নিতেও প্রস্তুত ছিল শিক্ষা বোর্ডগুলো।

এরই মধ্য হানা দিল করোনাভাইরাস মহামারী পরীক্ষার ১৫ দিন আগে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। পরীক্ষার্থীরা পরে দুশ্চিন্তায়। ১৫ দিন, একমাস করে ছুটি বাড়াতে বাড়াতে চলে আসল অক্টোবর। বিগত এই ৮ মাস পরীক্ষার্থীদের পোহাতে হয়েছে নানান যন্ত্রণা। এমনি একজনের কথা বলছি আমি একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী আমাদের পরীক্ষা স্থগিত কারণ করোনা ভাইরাস। যদি এখন কলেজে খোলা হয় তাহলে করোনা সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাই সরকার সকল ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মার্চের মধ্যে থেকে বন্ধ করে রেখেছে। হচ্ছে না পড়াশোনা, লকডাউনও ছিল অনেক দিন।  কিন্তু ঈদুল ফিতর এর পর থেকেই সকল কিছুই আগের মতোই চলছে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া। 

গার্মেন্টসে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ করছে কারো করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে না তাদের জন্য কোন বাধা-নিষেধ নেই। যদি সরকারি আইন করা আছে স্বাস্থ্যবিধি মানার মাক্স পড়ার কিন্তু দেশের ৮৫ ভাগই মানছেন না তা। তারা আক্রান্তও হচ্ছে না। 

সরকারের নির্বাচন কমিশন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, পৌরসভার পরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করছে ভোট গ্রহণ চলছে। হাজার হাজার প্রার্থী প্রতিদিন কোটি কোটি কর্মী সাধারণ জনতাকে দিন প্রচারণা চালাচ্ছে  কোন বাধা নিষেধ নেই। করোনারও ভয় নেই।  হাটে-বাজারে মাঠে ঘাটে সকল জায়গায় সব কিছু ই ঠিকঠাক। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কেন? উত্তর করোনাভাইরাস সরকার দেশের শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচাতে চায় তাদের ঝুঁকি তো ফেলতে চায় না। 

এদিকে শিক্ষার্থীদের অবস্থা, দীর্ঘ ১০ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে কাজে লেগেছে। আমাদের অবস্থা ছিল কলেজে, কোচিং, বাসায় পড়েও ভালো ফলাফল করতে পারি না বছরে বছরে ১০%-৭০% ফেল করে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী। আর এখন কোন পড়াশোনা নেই তাদের কি অবস্থা আন্দাজ করতে পারেন?

দিয়ে দিলেন ‘অটো পাস’, যে সারা বছর পড়াশোনা করল সেও পাশ যে শুরু ভর্তি হয়ে স্কুল/কলেজের বারান্দায় পা দেয়নি সেও পাশ। পাশের বাড়ির চাচা বলেন, “এখন আর পড়তে হয় না ‘অটো পাস’, সারাদিন মোবাইল টিপাইলেই পাশ করা যায় এরা ভবিষ্যতে কি করবে? এখনের পড়াশোনার কোন দাম নাই। স্কুলে আসে আর যার এমনেই পাশ।”

আমার জানা মতে, দেশের গরীব ঘরের ১৩%-১৮% ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আবার অনেকই মাদ্রাসা শিক্ষায় চলে গেছে। 

প্রথম-একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত আটো প্রমোশন দিয়ে দিলেন। তারা নতুন বই নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছে, কি পড়েছে পড়ছে তা ভবিষ্যত বলবে?

এদিকে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ‘অটো পাস’ এর ঘোষণা দেওয়া হয় অক্টোবরের মাঝামাঝি। বলা হয়েছিল ফলাফল ডিসেম্বররের মধ্যে দেওয়া হবে। কিভাবে দেওয়া হবে ফলাফল তা নিয়েও নানা কথা প্রথমে বলা হল জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফল যোগ করে ২ দিয়ে ভাগ করে ফল দেওয়া হবে।  কিছুদিন পর বলা হল জেএসসির ২৫% ও এসএসসির ৭৫% নিয়ে হবে ফল। এর কয়েক দিন পর বলা হল চতুর্থ বিষয়ের নাম্বার বাদ দিয়ে হবে ফলাফল। 

পরীক্ষার্থীরা মানল না, তারা আন্দোলন করতে লাগল। তারা বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন করল মিছিল-মিটিং করল যাই হউক তাদের দাবি আদায় হল চতুর্থ বিষয়সহ হবে ফল।

ডিসেম্বরে শুরুতে হয় তারিখ, ২৫ তারিখে দেওয়া হবে ফলাফল। বুক ভরা আশা নিয়ে অপেক্ষায় প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থী, বিগত দিনগুলোতে অনেকই প্রস্তুতি নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফলাফলের পরই হবে পরীক্ষা। 

২৫ ডিসেম্বর আশার কয়েক দিন পূর্বেই শুনা গেল ফলাফল প্রকাশ হচ্ছে না ২৫ তারিখ হবে ২৭ তারিখ। কিন্তু ২৬ তারিখ বিকাল বেলা বলা হল ফলাফল প্রকাশ হবে ৩১ তারিখ। খুব ভাল নাটক চলতে লাগল। পরীক্ষার্থীরা হতাশায় দিন পার করছিল। এরপর পরই শুনা গেল পরীক্ষা ছাড়া ফলাফল প্রকাশ করা অবৈধ এমন কোন নিয়ম নেই। তাই একটি অধ্যাদেশ লাগবে এটা কে বৈধ করতে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই হবে অধ্যাদেশ জারি করে ফলাফল প্রকাশ। কিন্তু হল না মন্ত্রিসভার বৈঠক। এখন বলা হচ্ছে যে জানুয়ারিতে ফলাফল প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা নেই হবে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। এভাবে তাদের কত সময় নষ্ট হচ্ছে তুমি জান?

আমাদের দেশে সরকারি চাকরির বয়স ৩০ বছর। পড়াশোনা করতে লাগে নিয়মিত হলেও ২৭-২৮ বছর। এবার করোনাভাইরাসে চলে গেল ১ বছর। আরও কত দিন যায় ঠিক নেই।

কবে ফলাফল প্রকাশ হবে তার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হবে কে কোথায় ভর্তি হবে, এর পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি তা যেন এখন একটা অনিশ্চিত হয়ে পরেছে। সেদিন জিজ্ঞেস করলাম একজনকে কি পড়াশোনার কি অবস্থা উত্তরে কেঁদে কেঁদে বলল পরীক্ষা যেখানে অনিশ্চিত পড়াশোনা সেখানে বিলাসিতা। 

এইচএসসির ফলাফলের অধ্যাদেশ এর জন্য কি জরুরী ভিত্তিতে একটি ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা করা যায় না?  আমরা তো সবাই ডিজিটাল বাংলাদেশের নাগরিক!

প্রাথমিক কোন কিছু ছাড়াই দিয়ে দিলেন অটোপ্রমোশন তারা বিগত শ্রেণিতে মাত্র দুই-তিন মাস ক্লাস করেছে, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি দেশের ৮০% শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেনি? তারা এখনও বাসায় পড়ছে কিনা খোঁজ নেওয়া কেউ কি আছে? পড়াশোনার কিছুই হচ্ছে না। 

মাধ্যমিকে মাস দুয়েক অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে অ্যাসাইনমেন্ট এনেছে আর বই খোলারও দরকার পড়েনি, ইন্টারনেটে সুন্দর করে উত্তর দেওয়া রয়েছে সেখান থেকে তারা কপি করে করে জমা দিয়ে দিয়েছে।

এটা দেশের ৯০% ভাগের বেশি শিক্ষার্থীর অবস্থা। আর অনলাইন ক্লাস লক্ষ লক্ষ টাকা বাজেট করে ক্লাস রেকর্ড করা হয়েছে কিন্তু কজন শিক্ষার্থী ক্লাস করেছে শতকরা ১০ জনও হবে না। কেন করেনি, করেছে কি না এর লোন তদারকি/রিপোর্ট আছে কারো কাছে?

উচ্চ মাধ্যমিকেও ‘অটো প্রমোশন’ দিয়ে দিলেন। ব্যবস্থা অনলাইন ক্লাস, যা মাধ্যমিকের চেয়ে আরও নাজুক। বিগত ১০ মাসে লেখাপড়া ছেড়ে কাজে ধরেছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে গরীব-অসহায় কৃষক দিনমজুর ঘরের শিক্ষাথী অভিভাবকেরা।

দেশের শিক্ষাঙ্গনের এই অবস্থা তো জাতির জন্য ভালো কিছু নয়। মেধা শূন্যের প্রয়াস। আমর এত সব কথায় কেউ বলতে পারেন ‘আপনি কি মঙ্গলগ্রহ থেকে এসেছেন, চোখ কি দেখেন না বিশ্বজোড়া করোনাভাইরাস মহামারী?’ না আমি মঙ্গলগ্রহ থেকে আসিনি সব কিছু দেখেই বলছি।

আচ্ছা বলুন তো করোনাভাইরাস কি শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই যায়? অন্য কোথাও যেতে পারে না? আপনরা কোন শিক্ষার্থীদের করোনার দোহাই দিয়ে আবদ্ধ করে রাখছেন?

মা সারা দিন হাজার হাজার মানুষ ভিড়ে গার্মেন্টেসে কাজ করে বাসায় ফিরে কোন করম সুরক্ষা ছাড়া, স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করা এই মায়ের সন্তানকে আপনি করোনার ভয় দেখান? বাবা সারা দিন রাস্তায় রিকশা চালায় রাতে খাবার নিয়ে বাসায় ফিরে বৌ-বাচ্চা নিয়ে রাত কাটায়, আপনি সেই বাবার সন্তানকে করোনার ভয় দেখান। সারাদিন হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালায় রাতে বাসায় একসাথে থাকে, তার ভাই-বোনকে আপনি করোনার ভয় দেখান। বোন সারা দিন মাঠে কিস্তি আদায় করে বাসায় ফিরে সবাইকে নিয়ে সময় কাটায় আর তার ভাই-বোনকে আপনি করোনার ভয় দেখান? শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটের দাবিতে মানববন্ধন-মিটিং করছে। অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলে দেওয়ার জন্য মানববন্ধন করছে প্রতিনিয়ত তাদের হচ্ছে না করোনা।

নিজেরা ভাবুন তো যা করছেন যা হচ্ছে তা কি ঠিক? একজন ৭-৮ বছরের বাচ্চাও এখন বুঝে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস নিয়ে নাটক চলছে নাটক। 

যদি করোনার ভয় থাকত তাহলে দেশের সকলের জন্য। আবদ্ধ থাকলে সবাই থাকবে। সকল কিছু খোলা রেখে সবাইকে মুক্ত স্বাধীন রেখে শুধু শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে। পড়াশোনা ছাড়া ‘আটো পাস’ দিয়ে দেশের মেধা শক্তিকে অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেওয়ার নামান্তর নয় কি?

লেখক: ২০২০ সালের এইচএসসি ফলপ্রার্থী