রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বিভাগের সভাপতি নিয়োগ কি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন নয়?

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে উপাচার্য এম আব্দুস সোবহানসহ তাঁর প্রশাসনের বিভিন্ন অনিয়মের তদন্ত করেছে ইউজিসি (বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন) এবং তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে ২ মাস আগে জমা দেওয়া হয়েছে। দুই সদস্যের ইউজিসির তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম। ইউজিসি তদন্তের জন্য উন্মুক্ত শুনানির আয়োজন করে কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বক্তব্য নিয়েছিল।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য এম আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা শিথিল করে (২০১৫ সালের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ২০১৭ সালে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমিয়ে) এর মাধ্যমে কম যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক হন উপাচার্যের কন্যা ও জামাতা। এছাড়া রাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে— শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও নিয়োগ বাণিজ্য এবং উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান কর্তৃক রাষ্ট্রপতিকে ধোঁকা দেওয়া ও এডহক ও মাস্টাররোলে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য, উপাচার্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে দুর্নীতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩ লঙ্ঘন করে বিভিন্ন বিভাগের সভাপতি নিয়োগ ইত্যাদি।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এর তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সত্যতা পেয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম দূরীকরণ সহ শিক্ষা ও গবেষণার মান সুরক্ষার স্বার্থে ১০ ডিসেম্বর ও ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে কিছু নির্দেশনা দেন ও কিছু বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করেন। উল্লেখযোগ্য নির্দেশনাগুলো হলো:

১) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল নিয়োগ কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিতকরণ।

২) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের নিয়োগ নীতিমালা বাতিল করে ১৯৭৩ এর আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত অন্যান্ন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন।

৩) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কর্তৃক নিয়ম বহির্ভুতভাবে দখলে রাখা ডুপ্লেক্স বাড়ির ভাড়া ৫,৬১,৬০০/- (পাঁচ লক্ষ একষট্টি হাজার ছয়শত) টাকা সরকারী কোষাগারে জমা প্রদানপূর্বক চালানের কপি জরুরী ভিত্তিতে  শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রেরণ।

৪) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার  প্রফেসর এম এ বারীকে অসদাচরণের জন্য রেজিস্ট্রার পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৭ ডিসেম্বর সেসময়কার ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এম এ বারী স্বাক্ষরিত এক আদেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. বিশ্বনাথ শিকদারকে নব সৃষ্ট মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে প্রেষণে বদলি করে অধ্যাপক শিকদারকে তিন বছরের জন্য নতুন বিভাগটির সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। এছাড়াও এতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগে ড. বিশ্বনাথ শিকদারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গবেষণাগারের সকল যন্ত্রপাতি সম্পূর্ণরূপে নবসৃষ্ট মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে স্থানান্তরের শর্ত প্রদান করা হয়।

এ বিষয়ে জেনেটিক ইজ্ঞিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. জিন্নাত ফেরদৌসি গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা গত রবিবার ১৭ই ডিসেম্বর রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত আদেশের একটি অনুলিপি পাই। আদেশটি পাওয়ার পাওয়ার পর বিভাগের একাডেমিক কমিটি ও প্ল্যানিং কমিটির জরুরী সভার আহ্বান করা হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে আদেশটিতে আপত্তি জানানো হয়েছে। আদেশটি প্রত্যাহার করতে আমরা রেজিস্ট্রারকে একটি পত্র প্রেরণ করব।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিভাগগুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ অনুযায়ী, জেষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে বিভাগের সভাপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি রুটিন ওয়ার্ক। যদিও, রাবি উপাচার্য করোনা সঙ্কটকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ লঙ্ঘন করে কয়েকটি বিভাগে সভাপতি নিয়োগ দিয়েছেন। বাধ্য হয়ে ২/১ জন শিক্ষক (আমি ভুক্তভোগী সহ) আদালতের আশ্রয় নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়েছে।

কিন্তু, নব সৃষ্ট বিভাগে সভাপতি নিয়োগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ প্রযোজ্য নয় এবং তা রুটিন ওয়ার্ক নয় কারণ সেখানে কোন শিক্ষক থাকে না। তবে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা “রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল নিয়োগ কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিতকরণ” থাকা সত্তেও, কেন নবসৃষ্ট মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে সভাপতি নিযুক্ত করা হলো? গত ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতীয় জনগণের পক্ষ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া দুটি বাসের চাবি হস্তান্তর অনুষ্ঠান শেষে আপাতত নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে কিনা এমন প্রশ্নে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, “না না, চিঠি আসলোই তো কালকে। এছাড়া রেজিস্ট্রারের অব্যাহতি বিষয়টি আইনি ব্যাপার।”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুল বারী উপস্থিত থাকায় ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত সভায় শিক্ষকদের তোপের মুখে পড়েন উপাচার্য এম আবদুস সোবহান। সেই সঙ্গে সভাও বর্জন করেছেন শিক্ষকরা। গত ১৭ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের সভাপতিত্বে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত মূল কমিটির সভা হওয়ার কথা ছিল।

সভায় উপস্থিত একাধিক শিক্ষক জানান, রেজিস্ট্রার আবদুল বারীর উপস্থিতি নিয়ে সভার শুরুতেই আপত্তি জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিনসহ অনেক শিক্ষক । সভায় উপস্থিত শিক্ষকরা বলেন, রেজিস্ট্রারের উপস্থিতিতে তারা কোনো ধরনের সভায় অংশগ্রহণ করবেন না। অসদাচরণের অভিযোগে আবদুল বারীকে অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে অধ্যাপক আব্দুল বারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়