বশেমুরবিপ্রবি: বছর জুড়ে আলোচনায় চুরি আর আন্দোলন

সালতামামি
বশেমুরবিপ্রবি

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০ শুরু হয়েছিলো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা নিয়ে। তবে দীর্ঘদিন যাবৎ উপাচার্যবিহীন থাকাসহ বিভিন্ন জটিলতায় সেই প্রত্যাশা অনেকটাই অপূর্ণ থেকে গিয়েছে। বছরের প্রথম এবং শেষের দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে হয়েছে বিভিন্ন দাবিতে একের পর এক আন্দোলন। আর মাঝের সময়টায় বিশ্ববিদ্যালয়টি আলোচিত ছিলো একের পর এক চুরির ঘটনায়। ২০২০ এ বশেমুরবিপ্রবির আলোচিত ঘটনাসমূহ নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের বিশেষ প্রতিবেদন

নবীন বরণে বছর শুরু: ২ জানুয়ারি ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেয়ার মাধ্যমে বছর শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। উপাচার্য (চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মো: শাহজাহানের সভাপতিত্বে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো: ছাদেকুল আরেফিন।

বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয়: করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বছরের বেশিরভাগ সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও ২০২০ এর ১ জানুয়ারি থেকে শুরু করে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বশেমুরবিপ্রবিতে বিভিন্ন দাবিতে একাধিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। এসকল আন্দোলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (ইটিই) বিভাগকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের (ইইই) সাথে একীভূতকরণের দাবিত ইটিই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারীদের আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক ইতিহাস বিভাগের অনুমোদনের দাবিতে ইতিহাস শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, প্রাপ্যতার তারিখ হতে আপগ্রেডেশনের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন এবং শেখ হাসিনা আইসিটি ইনস্টিটিউটের সিএসই ও ইইই বিভাগকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সিএসই ও ইইই শিক্ষার্থীদের সাথে একীভূতকরণের দাবিতে শেখ হাসিনা আইসিটি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এদের মধ্যে ইতিহাস বিভাগের আন্দোলনের কারণে ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা ১৫ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ ছিলো। পরবর্তীতে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি বশেমুরবিপ্রবির বিভিন্ন বিভাগে চলমান সমস্যা নিরসনে প্রফেসর ড. দিল আফরোজ বেগমকে প্রধান করে সাত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে ইউজিসি।

৫ বছর পর প্রভাতফেরী, ৭ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন: দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ২০২০ এর ২১ ফেব্রুয়ারি বশেমুরবিপ্রবিতে ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রভাতফেরি অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোঃ শাহজাহান, শিক্ষার্থী উপদেষ্টা কাজী মসিউর রহমানসহ বিভিন্ন বিভাগের প্রায় শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী অংশগ্রহণে এ প্রভাতফেরি অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ৮ জুলাই দীর্ঘ সাত বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন করা হয়। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক খাইরুল আলম থাকাকালীন সময়ে সর্বশেষ প্রভাতফেরি অনুষ্ঠিত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন করা হয়।

বাড়িভাড়া মওকুফ ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা: করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার পর মেসভাড়া মওকুফ ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট দাবি জানায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাড়িভাড়া মওকুফের বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে এবং বাড়িওয়ালাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে উক্ত কমিটি গোবরা ও নিকটবর্তী এলাকায় ৫০% এবং অন্যান্য এলাকায় ২৫% বাড়িভাড়া মওকুফের ব্যবস্থা করে। এছাড়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বিভাগীয় সভাপতিদের মাধ্যমে সহযোগিতা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি শিক্ষকদের পক্ষ থেকেও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তার উদ্দেশ্যে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়।

নতুন উপাচার্য নিয়োগ: সাবেক উপাচার্যের পদত্যাগের প্রায় ৯ মাস পর ২ সেপ্টেম্বর নতুন উপাচার্য পায় বশেমুরবিপ্রবি। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ বৃত্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সচিব সৈয়দ আলী রেজা স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. এ কিউ এম মাহবুবকে বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

বছরজুড়ে আলোচনায় চুরি: বশেমুরবিপ্রবিতে ২০২০ এ সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলো বিভিন্ন চুরির ঘটনা। এসকল ঘটনার মধ্যে সর্বপ্রথম ঈদুল আজহার ছুটি চলাকালীন সময়ে ২৬ জুলাই বশেমুরবিপ্রবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে ৪৯ টি কম্পিউটার চুরি হয়। পরবর্তীতে মহাখালীর হোটেল ক্রিস্টাল ইন থেকে ৩৪টি কম্পিউটার উদ্ধার করে পুলিশ এবং এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীসহ ৮ জনকে আটক করা হয়। এই চুরির রেশ কাটতে না কাটতেই বশেমুরবিপ্রবির ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগ এবং অফিসার্স কোয়ার্টারে চুরির ঘটনা ঘটে। এদের মধ্যে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে ২ টি কম্পিউটার ও একটি রাউটার আর অফিসার্স কোয়ার্টার থেকে স্যানিটারি ফিটিংস চুরির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার প্রায় এক মাস পার না হতেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পুনরায় চুরির ঘটনা ঘটে। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকো চেক চুরির মাধ্যমে আড়াই লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। এসকল ঘটনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হল থেকেও কয়েকজন শিক্ষার্থীর মালামাল চুরির অভিযোগ ওঠে।

চুরির ঘটনার বিচার নিয়ে জটিলতা: বশেমুরবিপ্রবিতে একের পর এক চুরির ঘটনা ঘটলেও এসকল ঘটনার বিচারের বিষয়ে অনেকটাই নীরব থাকতে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। লাইব্রেরি থেকে ৪৯ কম্পিউটার চুরির ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এবং চেক চুরির ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারীর সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে কম্পিউটার চুরির ঘটনা তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটিকে ঘিরে বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হয়। তদন্ত কমিটিকে সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে রাখতে ১৮ আগস্ট কমিটির এক সদস্যকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এরপরই অভিযোগ ওঠে অব্যহতিপ্রাপ্ত সদস্য তদন্ত কমিটিতে থাকা তিন শিক্ষকসহ পাঁচ সদস্যকে হুমকি দিয়েছেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা রেজিস্ট্রার বরাবর একটি অভিযোগপত্র দেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকদেরকে হুমকি প্রদানকারীর বিচার দাবি করে একাধিকবার মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।

দুর্ঘটনা আর আত্মহত্যায় তিন শিক্ষার্থীর বিদায়: ২০২০ এ বশেমুরবিপ্রবি হারিয়েছে তিন শিক্ষার্থীকে। এদের মধ্যে ইতিহাস বিভাগের আরিফুল ইসলাম (মুবিন) নামের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। এর কয়েকমাস পরে ১০ জুলাই পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যা করেন সাদিয়া কুতুব নামের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী এবং ১১ অক্টোবর হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন মনীষা হিরা নামের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের এক শিক্ষার্থী।

অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম: ১ জুলাই থেকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারের মত ৩১টি বিভাগে অনলাইন ক্লাস শুরু করেছিলো বশেমুরবিপ্রবি৷ কিন্তু ডিভাইস সংকট, আর্থিক সংকট ও দুর্বল ইন্টারনেটের কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকায় কিছুদিন পরেই বন্ধ হয়ে যায় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম। পরবর্তীতে নতুন উপাচার্য যোগদানের পর ১৮ অক্টোবর থেকে পুনরায় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে।

বশেমুরবিপ্রবি অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ: শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম বিষয়ক অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বশেমুরবিপ্রবি অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায় প্রকল্প পরিচালক বিধিবহির্ভূতভাবে খুলনা শিপইয়ার্ডকে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র বাবদ সর্বমোট ২৮ কোটি ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার ১৯৯ টাকা অগ্রীম প্রদান করেছেন এবং এসকল পণ্যের একটি বড় অংশের চাহিদা না থাকায় বর্তমানে অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হচ্ছে। বিষয়টি সর্বত্র আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি করলে ২৩ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালক আশিকুজ্জামান ভুঁইয়া।