মুখের লালায় ‘ডি-সাইক্লোসেরিন’ অ্যান্টিবায়ােটিক জিন শনাক্ত

অ্যান্টিবায়ােটিক জিন শনাক্ত
মুখের লালায় ‘ডি-সাইক্লোসেরিন’ অ্যান্টিবায়ােটিক জিন শনাক্ত

সুস্থ্য মানুষের মুখের লালায় যক্ষ্মা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ‘ডি-সাইক্লোসেরিন’ নামক একটি শক্তিশালী অ্যান্টিবায়ােটিকের কার্যকারিতাকে নষ্ট করে দিতে পারে এমন একটি জিনের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ‘ডি-অ্যালানিন-ডি-অ্যালানিন লাইগেজ’ নামক এই জিনটি প্রথমবারের মত ‘ইন্টেগ্রন জিন ক্যাসেট’ নামক এক ধরণের ক্ষুদ্র ভ্রাম্যমাণ জেনেটিক উপাদানের মধ্যে শনাক্ত হয়।

বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের দুটি পৃথক নমুনা সেটের প্রায় সকল সুস্থ্য স্বেচ্ছাসেবকের লালায় এই ভ্রাম্যমাণ জিনের সন্ধান পেয়েছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন, কিংস কলেজ লন্ডন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।

জিনটির দুইটি আইসােফর্ম শনাক্ত হয়েছে যার একটি আরেকটির তুলনায় চারগুণ শক্তিশালী। দাঁতের ক্ষয় রােগের জন্য দায়ী ট্রেপােনেমা ডেন্টিকোলা নামক এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া এ জিনটি বহন করছে বলে প্রমাণ পেয়েছেন তাঁরা।

জিনটির সামান্য জেনেটিক পরিবর্তন হলে এর পােষক ব্যাকটেরিয়া ভ্যানকোমাইসিন নামক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়ােটিকের কার্যকারিতাকে নষ্ট করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত এক প্রকাশনা সংস্থা নেইচার রিসার্চ কর্তৃক প্রকাশিত ‘সায়েন্টিফিক রিপাের্টস’ জার্নালে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের মাইক্রোবিয়াল ডিজিজেস বিভাগে প্রায় তিন বছর আগে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে ড. অ্যাডাম রবার্টস ও অধ্যাপক পিটার মুলানীর তত্ত্বাবধানে এ গবেষণাটির মূল কাজ সম্পন্ন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান। তাঁর পিএইচডি গবেষণার অংশ হিসেবে এ গবেষণা প্রকল্পটি সম্পন্ন হয়। কিংস কলেজ লন্ডনের ড. খন্দকার মিরাজ রহমানের ল্যাবে গবেষনাটির একটি অংশ সম্পাদিত হয়।

কাজটির গুরুত্ব এবং অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স মোকাবেলায় তাঁর গবেষণালদ্ধ ফলাফল কি কাজে লাগবে জানতে চাইলে ড.আজিজুর রহমান বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স মোকাবেলা করতে হলে ব্যাকটেরিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতার জন্য যে জিনগুলো দায়ি, তার উৎস খুঁজে বের করা খুবই জরুরী। কেননা অধিকাংশ রোগ সৃষ্টকারী ব্যাকটেরিয়া শুরুর দিকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ছিলনা। অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার ও অপব্যবহারের কারণে একসময়ের অ্যান্টিবায়োটিক সংবেদনশীল ব্যাকটেরিয়া নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় জেনেটিক মিউটেশন (জিনের গঠনগত পরিবর্তন) অথবা অন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার ভ্রাম্যমাণ রেজিস্ট্যান্স জিন সংগ্রহ করে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে।

তিনি বলেন, জেনেটিক মিউটেশন বা ভ্রাম্যমাণ রেজিস্ট্যান্স জিন সংগ্রহ করে কি কি কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে একসময়ের অ্যান্টিবায়োটিক সংবেদনশীল ব্যাকটেরিয়াগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠলো তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং বিজ্ঞানীরা এ সকল কৌশলকে টার্গেট করে বেশ কিছু সফল অ্যান্টিবায়োটিক আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াগুলোতে ভ্রাম্যমাণ রেজিস্ট্যান্স জিনের প্রাথমিক উৎস কি তা পরিস্কার ছিলনা।

সেক্ষেত্রে সুস্থ্য মানুষের মুখগহ্বরে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়াও রেজিস্ট্যান্স জিনের বাহক হতে পারে। ফলে সুস্থ্য মানুষের লালায় যে জিনটি সনাক্ত হয়েছে সেটি ভ্রাম্যমাণ হওয়ায় খুব সহজেই যক্ষ্মাসহ অন্য রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিন মাস ধরে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করলেও প্রায় সকল স্বেচ্ছাসেবীদের লালায় এ জিনের সন্ধান পাওয়া বিস্ময়কর বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এই গবেষক মনে করেন, দু'দেশের (বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য) কমন খাদ্য উপাদান যেগুলাের জীবাণু প্রতিরােধী ক্ষমতা রয়েছে, সে রকম উপাদানকে মােকাবেলা করার জন্য সম্ভবত মুখগহ্বরের কিছু ব্যাকটেরিয়া এ জিনটিকে কাজে লাগাচ্ছে। আমাদের গবেষণার ফল অ্যান্টিবায়ােটিক প্রতিরােধী ব্যাকটেরিয়ার উদ্ভব হওয়ার পিছনে খাদ্য উপাদানের ভুমিকা নিয়ে নতুন গবেষণার দুয়ার উন্মুক্ত করলো।

প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুঘটিত সংক্রমণের কারণে মৃত্যুবরণ করছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন এই সংখ্যা দিনে দিনে বাড়বে এবং বিশ্বব্যাপী দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে ১০ মিলিয়নে দাঁড়াবে।