বিজ্ঞানের অপব্যবহারে নষ্ট হচ্ছে নৈতিকতা

আসমাউল মোত্তাকিন সরকার
আসমাউল মোত্তাকিন সরকার

পৃথিবীর আয়ু বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলছে আমাদের সামনে। বিজ্ঞানের যত অগ্রগতি হচ্ছে মানবসমাজ ততোই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে?

বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীর চলছে। গুটিগুটি পায়ে সভ্যতার একেকটি ধাপ অতিক্রম করছি আমরা। কিন্তু কখনও কি আমাদের মনে প্রশ্ন এসেছে, এই বিজ্ঞান আমাদের কাছ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ করে নিয়েছে?তথ্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের ফলে মানুষ যেমন উন্নতির শিখর আরোহণ করেছে, তেমনি এর অপব্যবহারের ফলে নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রযুক্তির এই নেতিবাচক দিকগুলো আমাদের সমাজের মানুষগুলোকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে?

আগেকার দিনে শিশুদের ঘুম ভাঙত মায়ের কাছে ‘ভোর হলো, দোর খোলো’ অথবা আযানের ডাক শুনে। তবে বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন শিশুদের ঘুম ভাঙে এলার্মের শব্দে। রাতে ঘুমানোর সময় শিশুরা চাদের দিকে দিকে তাকিয়েও ভিন্ন ভিন্ন রূপকথার গল্প শুনত অথবা ঘুম পাড়ানির গান শুনত। আর বর্তমানে? এখন তো সবাই আধুনিক মা? সে তো ভীষণ ব্যস্ত! তার আর কি গল্প করার সময় হবে!

অনেক সময় মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে নেটের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাদের অনেকেই মনে করে অযথা সন্তানদের নিয়ে পড়ে থাকব কেন? ডে-কেয়ার আছে না!এবার বলি আমাদের তরুণ-তরুণীদের কথা। বর্তমানে অধিকাংশ তরুণদের পকেটে কিছু না পাওয়া গেলেও একটা স্মার্টফোন অনায়েসেই মিলবে। আর এই স্মার্টফোনে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে বিশ্ব এখন সবার হাতের মুঠোয়।

বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলা? সে তো এখন আর হয়ে উঠে না! এখন অনলাইন গেইম আছে না! শুধু শুধু রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ও শ্রম দিয়ে কষ্ট করে কেন খেলতে হবে। তার চেয়ে অনলাইনের গেইমই ভালো! এখন আর অবসর সময়টা পরিবারকে দেওয়া হয় না। ঘরের কোনায় বসে থাকা হয় স্মার্টফোন নিয়ে। যা চাই সব আছে এতে। আবার আত্মীয়-স্বজন এলে তাদের সাথে দেখা করার সময় কই? তার চেয়ে বরং রুমের দরজা বন্ধ করে অনলাইনে আড্ডা হয়ে যাক! ফলে তরুণদের বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে আড্ডা বা খোশগল্প করা হয় না।

আর বন্ধুদের সাথে আড্ডার সেলফিটাই তো গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা নয়। ভাবতেও অবাক লাগে, এখন সৃজনশীলতাও দেখা যায় না, হারিয়ে যাচ্ছে! কিন্তু কেন? কষ্ট করে পড়ার চেয়ে কপি করাতো অনেক সহজ। যার কারণে দেশের নাগরিকদের আর্থিক, সামাজিক মানসিক অবক্ষয়ের হার বাড়ছে।

প্রযুক্তির এই অপব্যবহার তাদের ব্র্যান্ড, ইমেজ, ও গ্লামারের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করে। কারণ প্রযুক্তি সমাজে নানামুখী চাহিদা এবং ভোগের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করছে। ফলে এটির অনুকরণে যুবসমাজ ভালো-মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না।

ইন্টারনেট, ইউটিউব, পর্নোগ্রাফি আসক্তিতে উন্নত দেশগুলোর প্রায় ৬৫ শতাংশ যুবসমাজ (১২-১৮ বছর) যৌন হয়রানি ও ধর্ষণসহ বড় ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। যা সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। এক জরিপে দেখা গেছে, পর্ণ আসক্তিতে প্রতি বছর আমেরিকার স্কুলপড়ুয়া ২ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষার্থী গর্ভবতী হচ্ছে, যা পুরো সমাজ ও একটি রাষ্ট্রের জন্য রীতিমতো হুমকিস্বরূপ। (সূত্র : ন্যাশনাল ক্রাইম প্রিভেনশন সার্ভে)। এমনটা যে আমাদের দেশে এমন ঘটছে না, তা কিন্তু নয়।

সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, নতুনত্বের প্রতি তরুণ সমাজের আসক্তি, সামাজিকভাবে সচেতনতার অভাব, পরিবারের উদাসীনতা, ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে জীবনযাপন, সুফল-কুফল বিচার বিবেচনা না করেই প্রযুক্তির ব্যবহার, সঙ্গ দোষ, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবই মূলত সাইবার ক্রাইম সংঘটনের মূল কারণ। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগের গাফিলতিও এ জন্য অনেকাংশে দায়ী।

এর প্রতিকার হিসাবে তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রিক অপরাধের বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী ড. মেহতাব খানব বলেন, আইনের প্রয়োগের চেয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো বেশি জরুরি। পরিবারের অসচেতনতাও যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে হবে। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সুষ্ঠু বিনোদনের অভাব থেকেই মূলত ধ্বংসের পথে পা বাড়াচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় লাইব্রেরি ও খেলাধুলার ক্লাব স্থাপন করতে হবে। পরিবারকে সন্তানের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধ করতে সরকারেরও সমান দায়িত্ব রয়েছে।

এর প্রতিকার হিসাবে ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার ব্যাপারে সামাজিক সচেতন বৃদ্ধির বিকল্প নেই। পাশাপাশি পরিবারের অপ্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের ওপর বড়দের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বশেষে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সঠিক ও উপযুক্ত ব্যবহারই পারে আমাদের একটি সুন্দর সমাজ উপহার দিতে।

লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি