ডিবি পরিচয়ে মানুষকে তুলে নিয়ে যেত ইরফান বাহিনী

হাজী সেলিমের ছেলে মো. ইরফান সেলিম
হাজী সেলিমের ছেলে মো. ইরফান সেলিম

নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইরফান সেলিমসহ তাঁর দেহরক্ষী জাহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। বিদেশি মদ পানের জন্য ছয় মাস ও বাসায় অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার দায়ে আরও ছয় মাসসহ এক বছর করে এই দুজনকে কারাদণ্ড দিয়েছেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

আজ সোমবার দুপুরে চকবাজারে হাজী সেলিমের বাসায় অভিযান করে র‌্যাব। র‌্যাব জানিয়েছে, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে এবং একজন ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত আসামি সাংসদ হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের বাসায় অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এ সময় সাংসদ বাসায় ছিলেন না।

সন্ধ্যায় র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, অভিযানের সময় বাসা থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, ইয়াবা, বিদেশি মদ, ১০ ক্যান বিয়ার, হ্যান্ডকাপ, অনুমোদনহীন ৩৮টি ওয়াকিটকি ও সেল উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ওয়াকিটকি রাখা ও বিদেশি মদ পানের কারণে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাৎক্ষণিক ভাবে গ্রেপ্তার দুজনকে দুটি মামলায় ছয় মাস করে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।

অভিযানে এক জোড়া হ্যান্ডকাফও উদ্ধার করেছে করেছে র‌্যাব। তাদের ধারণা, এই হ্যান্ডকাফ পরিয়ে হাজী সেলিমের লোকজন র‌্যাব ও ডিবি পরিচয় দিয়ে মানুষকে ধরে নিয়ে যেত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানান, ওই বাসায় একটি ড্রোন, রাউটার, একটি ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার বা ভিপিএস পাওয়া গেছে। এই ভিপিএস দিয়ে মূলত তার পুরো নেটওয়ার্কে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতো, যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ট্র্যাক করতে না পারে। সাধারণত ভিপিএস ব্যবহারের অনুমোদন পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা। বিটিআরসি এই অনুমোদন দেয়। তবে হাজী সেলিম কোনও অনুমোদন নেননি।

হাজী সেলিমের বাসায় কন্ট্রোল রুম

পুরান ঢাকা এলাকা ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করতে হাজী সেলিমের বাসায় গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিসহ অত্যাধুনিক কন্ট্রোল রুম। যেখানে ছিল আধুনিক ভিপিএস (ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার), ৩৮টি ওয়াকিটকি, ড্রোনসহ বিভিন্ন ডিভাইস। রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (ভিভিআইপি) নিরাপত্তায় নিয়োজিত এলিট বাহিনীর কাছে যেসব সরঞ্জাম থাকে, সেরকম সরঞ্জাম পাওয়া গেছে এখানে।

র‌্যাব কর্মকর্তারা বলেন, হাজী সেলিমের আট তলা ভবনের তিন ও চার তলা থেকে এসব সরঞ্জামসহ তারা অবৈধ একটি বিদেশি পিস্তল ও একনলা বন্দুক জব্দ করেছেন। কালো ৩৮টি ওয়াকিটকি উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ওয়াকিটকির প্রতিটি চার কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা কাভার করতো। এ ধরনের ওয়াকিটকি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র অনুমোদন ছাড়া ব্যবহার করা নিষেধ।

হাজী সেলিমের ছেলের বাসায় টর্চার সেল

ইরফান সেলিমের ভবনের পাশেই একটি টর্চার সেল পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে র‍্যাব। র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, আসিক টাওয়ারের ১৬ তলার একটি কক্ষকে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন ইরফান সেলিম। সেই রুমটিকেই টর্চার সেল হিসেবে গড়ে তুলেছেন তিনি।

আশিক বিল্লাহ জানান, ইরফান সেলিমের ভবনে একটি টর্চার সেল পাওয়া গেছে। সেখান থেকে হ্যান্ডকাপও উদ্ধার করা হয়েছে। বেলা সাড়ে ১২টার সময় তারা অভিযুক্তের বাসা এবং অভিযুক্তকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন। এরপর তারা সাংসদ হাজী মোহাম্মদ সেলিমের দ্বিতীয় ছেলে ইরফান মোহাম্মদ সেলিম এবং তার দেহরক্ষী জাহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হন।

এর আগে ২৫ অক্টোবর রাতে ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ‘সংসদ সদস্য’ লেখা সরকারি গাড়ি থেকে নেমে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধর করা হয়। রাতে এ ঘটনায় জিডি হলেও ২৬ অক্টোবর ভোরে হাজী সেলিমের ছেলেসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে ধাণমন্ডি থানায় মামলা করেন ওয়াসিফ।

মারধর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছে। আসামিরা হলেন, ইরফান সেলিম, এ বি সিদ্দিক দীপু, জাহিদ, মীজানুর রহমান ও অজ্ঞাতনামা আরও দুই/তিনজন।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ইরফানের গাড়ি ওয়াসিমকে ধাক্কা মারার পর নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিম সড়কের পাশে মোটরসাইকেলটি থামান এবং গাড়ির সামনে দাঁড়ান। নিজের পরিচয় দেন। এরপরই গাড়ি থেকে কয়েকজন বের হয়ে ওয়াসিমকে কিলঘুষি মারেন এবং তার স্ত্রীকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন। তারা মারধর করে ওয়াসিমকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যান।