মেধার মূল্যায়নে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত জরুরি

মুহম্মদ সজীব প্রধান
মুহম্মদ সজীব প্রধান

এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা! উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন ভাবনায় বিভোর তখনই করোনা মহামারির আগমন তাদের জীবনকে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে ঠেলে দিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় দীর্ঘ ছয় মাস পর এইসএসসি পরীক্ষার ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষক, অধ্যাপক থেকে শুরু করে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে দুর্ভাবনার অন্ত নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা রক্তপাতহীন এক মেধার লড়াই যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পরীক্ষার জন্য যেতে হয় যা বর্তমানে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে অনেক মতানৈক্য। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনের পরিবর্তে সরাসরি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এখনো সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেনি।

বস্তুত, অনলাইন পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার স্বচ্ছতা কতখানি থাকবে এবং প্রকৃত পরিশ্রমি ও মেধাবি শিক্ষার্থীদের খুঁজে পেতে কতটা কার্যকর হবে সে বিষয়ে জনমনে শঙ্কা রয়েছে। কারণ, এখানে পরীক্ষার হলের মতো শিক্ষকরা সরাসরি পরীক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না ফলে সেখানে নকল বিস্তারের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

এছাড়া, ভর্তি পরীক্ষার সাথে জড়িত কোচিং সেন্টারগুলো তাদেরকে সেরা প্রমান করতে অবৈধ উপায় অবলম্বন করার সুযোগ লুফে নিবে আর এতে প্রকৃত মেধাবিরা নিজেদেরকে প্রমান করার সুযোগ হারাবে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ বিশেষ সফটওয়্যার মাধ্যমে স্বচ্ছ ও নকলমুক্ত পরীক্ষা আশা করছেন কিন্তু ঐ সফটওয়্যারের মাধ্যমে যেহেতু এখনো কোনো পাবলিক পরীক্ষা হয়নি তাই সফটওয়্যারের সক্ষমতা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা সম্ভব হচ্ছে না।

তাছাড়া এতো বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা একসাথে সফটওয়্যারের মাধ্যমে নেওয়া যাবে কিনা সেটাও বলা যাচ্ছেনা কেননা সফটওয়্যার ব্যবহারে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে, যেসব শিক্ষার্থীদের বাড়ি শহরাঞ্চলে এবং অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ডিভাইস ও পরিবেশ রয়েছে তারা অনলাইন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারলেও যেসব শিক্ষার্থী বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে তারা হয়ত অনলাইন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেনা।

কেননা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ইন্টারনেটের বেহাল দশাসহ আধুনিকতার পুরো ছোয়া এখনো লাগেনি। শুধু তাই নয় অসংখ্য শিক্ষার্থী রয়েছে যারা দারিদ্রতার কারণে ডিজিটাল ডিভাইসের বাহিরে রয়েছে। সফটওয়্যারে পরীক্ষা নিতে গেলে একজন শিক্ষার্থীকে একটি রুমে একাকী বসে, ল্যাপটপ বা অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ডাটা সংযোগ রেখে নিজে নিজে অ্যাপ লগইন করে তারপর এক-দেড় ঘন্টায় পরীক্ষা দিতে হবে।

এরকম একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে ভর্তিযুদ্ধে একজন প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় থেকেই যায়। কারণ, যে শিক্ষার্থীর স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপ নেই এমনকি  নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সুবিধা নেই সেখান থেকে অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করা অগ্নি পরীক্ষারই নামান্তর।

অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া হলে শহরাঞ্চল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি হবে এবং অনেক দরিদ্র ও মেধাবি শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এমতাবস্থায় সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের স্বার্থে অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা না নেওয়াই শ্রেয়।

এক্ষেত্রে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পরীক্ষার নম্বর কমিয়ে বিভাগীয় কিংবা জেলা শহরে পরীক্ষা নিলে শিক্ষার্থী বান্ধব হবে বলে মনে করি। সবচেয়ে ভালো হবে পরীক্ষার্থীদের আসন বিন্যাস নিজ নিজ জেলায় দেওয়া, এতে শিক্ষার্থীদের অন্য কোনো জেলায় যাতায়াত করতে হবেনা।

এছাড়া, মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ভিন্ন ভিন্ন দিনে নিতে হবে এবং প্রতিটি সিটে এক জনের বসার ব্যবস্থা রেখে অধিকসংখ্যক কেন্দ্রে পরীক্ষার আয়োজন করতে হবে। যাতে পরীক্ষার কেন্দ্রে ও হলে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়। সর্বোপরি, বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগের ওপর নির্ভর করছে চৌদ্দ লাখ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের মেধার সঠিক মূল্যায়ন ও  ভবিষ্যত জীবন। মেধার মূল্যায়নে কর্তৃপক্ষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন এমনটাই প্রত্যাশা।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।