রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলছে

অধ্যাপক
মো. কামরুল হাসান মামুন

গতকাল এক টিভি চ্যানেলে সিলেট এমসি কলেজে গণধর্ষণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলেজের অধ্যক্ষকে জেরা করা হয়। অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল অধ্যক্ষই সব কিছুর জন্য দায়ী এবং যেভাবেই হউক তাকেই সব দায় শিকার করানোর চেষ্টা চলে। Poor him! আমরা এমনই। দুর্বলের উপরই সকল দায় চাপানোর চেষ্টা সকল মহল থেকেই থাকে।

পদার্থবিজ্ঞানে "causality" নামে একটি শব্দ আছে। এর মাধ্যমে আমরা cause and effect-এর মধ্যে সম্পর্ক জানতে পারি। যেখানেই আমরা effect দেখি সেখানেই আমরা cause খুঁজি। মনে রাখতে হবে সকল effect-এর জন্য অবশ্যই কোন না কোন cause দায়ী। আলোচ্য ক্ষেত্রে এখন চেষ্টা চলবে cause-কে আড়াল করার। ছাত্র সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, শিক্ষক সংগঠন সহ সকল সংগঠনই একেকটি পুতুল। সেই পুতুল নাচের সুতাতো ওই অধ্যক্ষের হাতে নেই। সেই সুতার গোড়া কার কাছে সেই প্রশ্নের উত্তরতো খোঁজেন না।

আমি এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের আবাসিক শিক্ষক ছিলাম। আমার মেয়াদকাল বিএনপি এবং আওয়ামীলীগ দুই সরকারের সময়কালই ছিল। তাই আমি দেখেছি এই দুই সরকারের মধ্যে বিন্দু মাত্র পার্থক্য ছিল না। পরিবেশ পরিস্থিতি সব সময়ই খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। এই বিবেচনায় যারা আগে ছিল তারা তুলনামূলক একটু বেটার ছিল। আবার একই সরকার এক মেয়াদকাল পরে যখন আবার এসেছে সেই সরকার তার আগের মেয়াদকাল থেকে আরো খারাপ হয়েছে। আমি দেখেছি সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন কি পরিমান আস্কারা পায়। এরা কোন অন্যায় করলে প্রশাসন চেষ্টা করে তাদের বাঁচাতে আর সরকার বিরোধী কেউ সামান্যতম অন্যায় করলে প্রাণপণ চেষ্টা করে সর্বোচ্চ সাজা দিতে।

একটি ঘটনা বলি। তখন বিএনপি ক্ষমতায় আর ছাত্রদল কমিটি যেন হল সংসদ। হল অফিসে আবাসিক শিক্ষকদের মিটিং শেষে প্রভোস্টের অফিস কক্ষে বসে আছি। এমন সময় একজন ছাত্রদল নেতা অফিসে ঢুকল। ঢুকে সোজা একটি সোফায় দুই শিক্ষকের মাঝের ফাঁকা জায়গায় ধুম করে বসে হাত দুটো মাথার পেছনে দিয়ে হেলান দিয়ে রিলাক্স মুডে বসে পরল যেন সে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসেছে। এরপর যখন আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে গড় চিত্র কি একটুও পাল্টেছে?

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা হলে শিক্ষকনেতারা আলাদা খাতির করে, পুলিশ আলাদা খাতির করে। এইসব আস্কারাই সকল সমস্যার cause! ছাত্রনেতা ও শিক্ষকদের মাঝে কোন ঝামেলা হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সরকারের প্রশাসন সবাই ছাত্রদের পক্ষ নিয়ে তাদের বাঁচিয়ে দিবে। আমি যেই হলের আবাসিক শিক্ষক ছিলাম সেখানে এক ছাত্রনেতার গুলিতে এক গরীব মেধাবী ছাত্র মারা গিয়েছিল। বিচার হয়েছে? শুধু ছাত্রনেতা কেন? শিক্ষক নেতারাও আস্কারা পায়। ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষক নেতা যদি যৌন হয়রানি করে বা প্লাগিরিজম করে বিচার না হওয়ার সম্ভবনা অনেক।

পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে ছাত্র এবং শিক্ষকরা এইরকম নগ্নভাবে জাতীয় রাজনীতিতে এমনভাবে জড়িত? শিক্ষকদের কাজ শিক্ষকতা ও গবেষণা করা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকনেতারা কি তা করছেন? এই দায়িত্ব না পালন করে তারা বরং যারা কিছুটা পালন করে তাদের চেয়ে অনেকগুন বেশি ভালো থাকেন। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সকল অন্যায় দূর করতে হলে ছাত্রদের জাতীয় রাজনীতিতে সরাসরি যোগ দেওয়াকে বন্ধ করতে হবে। ছাত্ররা রাজনীতি করবে কিন্তু বৃদ্ধদের ক্ষমতায় বসানো বা ক্ষমতা থেকে নামানোর রাজনীতি করবে না। কিন্তু জাতীয় ক্রাইসিস তৈরী হলে করবে। সেটা পৃথিবীর সকল দেশের ছাত্র শিক্ষক জনতাই করে।

আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলছে। ঠিক যেই সময় তাদের জ্ঞানার্জনের মোক্ষম সময় সেই সময়টা তারা তাদের মুনিবদের জন্য অপচয় করে। এইসব করতে গিয়ে সেশন জ্যাম লেগে যায়। তাই এখন তারা দাবি করছে চাকুরীর বয়স ৩৫ করতে হবে। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ১৭ বছর বয়সে পিএইচডি করে ফেলেছিল। অনেকে ৩৫ বছরে অধ্যাপক হয়ে যায়। যারা সরকার পরিচালনা করে তাদের লজ্জা হওয়া উচিত যে আমাদের যুব সমাজকে আজকে ৩৫ বছর চাকুরীর বয়সীমা করার দাবি করতে হয়। যেই শিক্ষকরা এইসব কুরাজনীতির অংশ হয়ে আমাদের আগত প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে তারা দেশের শত্রু।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়