ঢাকা কলেজের পুকুরে লাল শাপলার হাতছানি

“তুমি সুুতোয় বেঁধেছো শাপলার ফুল, নাকি তোমার মন” গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথা আর সুবীর নন্দী ও অনুপমা মুক্তির দরাজ কন্ঠে গাওয়া এই গানই আটষট্টি হাজার আবহমান গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনের রক্তস্রোতে মিশে যাওয়া শাপলা ফুলের অস্তিত্বের কথা জানান দেয়।

প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য খ্যাত ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে ঋতুভেদে নানান বৈচিত্র্যময় মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের পসরা দৃশ্যমান হয় এদেশের মাটি, মা আর মানুষের মাঝে। একেক ঋতুতে প্রকৃতি সাজিয়ে বসে ভিন্ন ভিন্ন রূপের পসরা। সেই ধারাবাহিকতায় বর্ষা এবং শরৎ কাল জুড়েই দেশের বিল-ঝিল, মুক্ত জলাশয়-জলাধার, ছোট-বড় পুকুর, হাওড়-বাওড়ে অনাবিল সৌন্দর্য্য আর ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ফোটে লাল শাপলা ফুল।

পুকুরের টলমলে স্বচ্ছ পানিতে সকালের নতুন সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সদ্য ফোঁটা লাল শাপলার হাসি মুখের মুখোমুখি হলে মুহূর্তের জন্য হলেও ক্লান্ত আর জীর্ণ শীর্ণ এই জীবনধারায় কিছুটা হলেও গতিময়তা আর নতুনের সঞ্চার ঘটে। জীবনের দূষিত রক্তস্রোতে আনন্দ আর নতুনের সঞ্চার করাতে প্রতিবছরের ন্যায় এবারো রাজধানীর ঢাকা কলেজের পুকুরের বিস্তীর্ণ পানিতে স্বল্প পরিসরে ফুটেছে লাল (রক্ত) শাপলা ফুল।

ঢাকা কলেজের পুকুরে শাপলা ফুল

কলেজের ক্যাফেটেরিয়ার পাশের পুকুরের পাড় সংলগ্ন অগভীর পানিতে সেই রক্ত শাপলার চোখ জুড়ানো হাসির দেখা মিললো। শুধু ফুলই নয় বরং ফুটন্ত ফুলের পাশেই আরও কলি পানি থেকে মাথা বের করে পূর্ণ ফুল হয়ে ফোঁটার প্রহর গুনছে। ভোরের সূর্যের আলোয় ফুটন্ত শাপলার চোখ জুড়ানো হাসি আশপাশের পরিবেশকে যেন আরও আলোকিত করে দেয়। মুগ্ধতা ছড়িয়ে পরিবেশকে আরও আপন করে নেবার আয়োজন স্পষ্টত উপচে পড়ছে। প্রকৃতি যেন তার নিজ হাতে ফুটন্ত লাল শাপলার হাসিকে সাজিয়ে দিয়েছে। লাল শাপলা যখন বিলুপ্তির পথে তখন শহরাঞ্চলের পুকুরে লাল শাপলার উপস্থিতি সুন্দরের প্রবাহকে সমুন্নত করছে বহুগুণে।

তবে এবারের ফুলে বিষাদের ছাপও স্পষ্ট। প্রতিবছরই লাল শাপলার এমন মনোমুগ্ধকর আয়োজন দেখে বিমোহিত হন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী, দর্শনার্থী সহ সবাই। কিন্তু এবছরের চিত্রটা অন্যসময়ের চেয়ে ঢের ভিন্ন! সংক্রমকব্যাধী করোনার প্রাদুর্ভাবে কলেজ বন্ধ থাকায় জনমানবশূন্য ক্যাম্পাসে একাকী নিভৃতেই জীবনের পরিব্যাপ্তি শেষ করেছে লাল শাপলার দল। আর ক্যাম্পাসের নানাবিধ উন্নয়ন প্রজেক্টে পুকুরের পানি ব্যবহৃত হওয়ায় এবছরের মতো লাল শাপলার জীবনাবসান ঘটেছে দ্রুত।

এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের কন্ঠেও বিষাদের শেষ নেই। কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী জুয়েল রানা বলেন, করোনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ ক্যাম্পাস। সবুজ ঘেরা ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক নৈসর্গিকতা প্রায়শই মনে পড়ে। এরমধ্যে এই মৌসুমে সবচেয়ে আকর্ষণীয় সৌন্দর্যের বিস্তৃতি ঘটাতো কলেজের পুকুরে ফোটা লাল শাপলা ফুল। যার সৌন্দর্য বরাবরই আমাদের মুগ্ধ করেছে। ভীষণ মিস করছি প্রিয় ক্যাম্পাসকে।

তবে দিনদিন নানাবিধ কারণে সংকুচিত হয়ে আসছে পুকুরের লাল শাপলা ফুলের উপস্থিতি। কলেজের কর্মচারী নাজির আহমেদ জানান, অনেক বছর ধরেই এই পুকুরে লাল শাপলার উপস্থিতি। আরও আট-দশ বছর আগে অনেক লাল শাপলা ফুটত। সকাল বেলায় সদ্য ফোটে থাকা লাল শাপলা দেখলে মনে হতো যেন লালগালিচা বিছিয়ে রাখা হয়েছে পুরো পুকুর জুড়ে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে গত কয়েক বছর ধরে অযত্ন, অবহেলা, মাছ চাষের সুবিধার জন্য কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে এখন লাল শাপলার উপস্থিতি হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

ঢাকা কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বললেন, পরিবেশের সজীবতা আর ভারসাম্য রক্ষার্থে প্রকৃতির সকল উপাদানই গুরুত্বপূর্ণ। শাপলা ফুল দেখতে যেমন সুন্দর তেমন এর ভেষজ গুণাগুণ ও পুষ্টিমানও অনেক সমৃদ্ধ। শাপলার রয়েছে প্রচুর ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাত গুণ বেশি।

তিনি বলেন, লাল শাপলা এ্যলার্জী ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। এছাড়াও শাপলা এ্যাসিডিটি, এ্যানেসথেসিক, সেরোটিক, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগের ঔষধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এই ফুলে ৪ থেকে ৫ টি বৃতি থাকে ও ১৩ থেকে ১৫ টি পাপড়ি থাকে। প্রায় বছরের সব সময় শাপলা ফুটতে দেখা গেলেও এই উদ্ভিদ জন্মানোর শ্রেষ্ঠ সময় বর্ষা ও শরৎ।