এবার পদোন্নতি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের অসন্তোষ

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষকের বিভাগীয় পদন্নোতি নিয়ে এবার অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন তারা। বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে লিখিত আবেদনও জানানো হয়েছে। এর আগে প্রাথমিক শিক্ষকদের উচ্চতর গ্রেড নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিলে তা সমাধান করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি এবং প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের জন্য একটিসহ মোট দুটি নিয়োগ বিধিমালা রয়েছে। এই দুটি বিধিমালার মধ্যে ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের গেজেটেড অফিসার ও নন-গেজেটেড কর্মচারীদের নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৫’ সংশোধন করা হচ্ছে।

শিক্ষকরা বলছেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের গেজেটেড অফিসার ও নন-গেজেটেড কর্মচারীদের নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৫’ -এর অধীনে প্রধান শিক্ষকদের পদোন্নতির বিধান ছিল। প্রধান শিক্ষকরা সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি পেতেন। এতে করে সহকারী শিক্ষকরাও নির্দিষ্ট সময়ে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির সুযোগ পেতেন। কিন্তু ১৯৯৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিধিমালাটি সংশোধনের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকদের পদোন্নতি রহিত করা হয়। এতে প্রধান শিক্ষকদের পাশাপাশি সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতিও বন্ধ হয়ে যায়।

প্রধান শিক্ষকদের দাবি, ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের গেজেটেড অফিসার ও নন-গেজেটেড কর্মচারীদের নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৫ (সংশোধনী ২০২০)’ এ বিভাগীয় পদোন্নতি পুনর্বহাল করতে হবে। কারণ এই বিধিমালা সংশোধন না করলে প্রধান শিক্ষকদের পরবর্তী কোনও পদে পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হবে না।  উপরের পদে সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদসহ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ), প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই), উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি), থানা রিপোর্স সেন্টার (টিআরসি), প্রস্তাবিত প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডসহ বিভিন্ন দফতরের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন সব পদে প্রধান শিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা রাখতে হবে।

বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির মুখপাত্র এস এম ছায়িদ উল্লা বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকদের ঊর্ধ্বতন পরবর্তী পদে পদোন্নতি পেতে হলে প্রস্তাবিত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের গেজেটেড অফিসার ও নন-গেজেটেড কর্মচারীদের নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৫ (প্রস্তাবিত সংশোধনী, ২০২০) এর খসড়ায় ৪৫ বছরের বয়সসীমার বাধ্যবাধকতাসহ প্রধান শিক্ষকদের মধ্য থেকে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শতভাগ পদে সরাসরি নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। এটা প্রধান শিক্ষকদেরকে পদোন্নতি না দেওয়ার কৌশল। আমাদের দাবি পরবর্তী ঊর্ধ্বতন পদে পদোন্নতির মাধ্যমে শতভাগ পদ পূরণ করতে হবে প্রধান শিক্ষকদেরকে বিভাগীয় পদোন্নতি দিয়ে। আর যদি কোনও কারণে শতভাগ পদে বিভাগীয় পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব না হলে অন্তত ৭০ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে বাকি ৩০ শতাংশ প্রধান শিক্ষকদের মধ্য থেকে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে পূরণের জন্য বিধান যুক্ত করতে হবে।  নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সের কোনও সীমাবদ্ধতা রাখা যাবে না।’

১৯৮৫ সালের নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন পদগুলো প্রধান শিক্ষকদের পদোন্নতি হতো বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বিধিমালায় বিভাগীয় প্রার্থীদের শতভাগ সরাসরি নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হলেও পদোন্নতি দেওয়া হবে বলা হয়নি। এটি পদোন্নতি না দেওয়ার কৌশল। এছাড়া আবেদনের ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৪৫ বছরের বয়সসীমা রাখা হয়েছে, যাতে কোনও শিক্ষক পদোন্নতি না পায়।  প্রাথমিক শিক্ষায় এমএলএসএস থেকে মহাপরিচালক পর্যন্ত সব পদে পদোন্নতির সুযোগ থাকলেও প্রধান শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ নেই।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের গেজেটেড অফিসার ও নন-গেজেটেড কর্মচারীদের নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৫’ অধিকতর সংশোধনের জন্য বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ পদোন্নতির বিধানসহ কিছু বিষয় সংশোধন করে আবার সচিব কমিটিতে পাঠাতে বলেছে মন্ত্রণালয়কে।

এস ছয়িদ উল্লাহ বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকের ঊর্ধ্বতন পদগুলোর পদোন্নতি যে সংশোধিত গেজেট বা ১৯৯৪ সালের কালো আইনের মাধ্যমে করা হয়েছে তা সম্প্রতি ভার্চুয়াল সভা করে সিনিয়র সচিবকে জানানো হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের গেজেটেড অফিসার ও নন-গেজেটেড কর্মচারীদের নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৫ (সংশোধনী ২০২০) তে প্রধান শিক্ষকদের উপরের পদসমূহে পদোন্নতির বিধান অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে গড়িমসি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এসডিজি-৪ এর লক্ষ্য পূরণের অংশ হিসেবে প্রস্তাবিত 'প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সমন্বিত নিয়োগ বিধিমালা ও সাংগঠনিক কাঠামোতে উপরের পদসমূহে প্রধান শিক্ষকদের পদোন্নতির বিধান যুক্ত করা হবে, যা অনেক সময়সাপেক্ষ বিষয়। তাই আমরা মনে করি, এখনই ১৯৮৫ সালের বিধিমালা (প্রস্তাবিত সংশোধনী ২০২০) -এ প্রধান শিক্ষকদের শতভাগ পদোন্নতির বিধান পুনর্বহাল করা হোক। ’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিকের যেসব পদে সরাসরি নিয়োগ চালু রয়েছে সেসব পদে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে আবেদনের সুযোগ দিতে হবে।  বিভাগীয় পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে হতে হবে এই বাধ্যবাধকতা রাখা যাবে না। ‘

বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব ও সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক থেকে জেলা শিক্ষা অফিসার পর্যন্ত শিক্ষকদের  বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির বিধান যুক্ত করতে হবে খসড়া নীতিমালায়।  এই ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ বিভাগীয় পদোন্নতি এবং ৫০ শতাংশ উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকদের পদোন্নতি দিতে হবে। অনূর্ধ্ব ৪৫ বছরের বয়সের কোনও বাধা থাকবে না।  কারণ একজন সহকারী শিক্ষকের প্রধান শিক্ষক হতেই ৪৫ বছর লেগে যায়, তাহলে ঊর্ধ্বতন থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতিতে অনূর্ধ্ব ৪৫ বছর শর্ত জুড়ে দিলে কোনও সহকারী শিক্ষক ওই পদে যেতে পারবেন না। ’

তিনি বলেন, ‘১৯৮৫ সালের নীতিমালার আগে বিভাগীয় পদোন্নতির ব্যবস্থা ছিল।  প্রাথমিকের যেসব পদে সরাসরি নিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে সেসব পদে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে নিয়োগের সুযোগ দিতে হবে সহকারী শিক্ষকদেরও। কারণ এখন সবাই দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে শিক্ষকতায় যুক্ত হচ্ছেন। যদি এই সুযোগ না থাকে তাহলে শিক্ষকতায় মেধাবীরা আসবে না।’

প্রস্তাবিত বিধিমালায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা না রাখা হলেও পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।  বর্তমানে এসব বিদ্যালয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রেষণে নিয়োগ দিয়ে পরীক্ষণ বিদ্যালয় পরিচালনা করা হচ্ছে। পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের নিয়োগ করা কোনও শিক্ষক আর নেই। সবই পদোন্নতি পেয়ে ঊর্ধ্বতন পদে পেয়েছেন। অনেকে পিটিআইয়ের ইনস্ট্রাকটর হয়েছেন।  বিগত সময় পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে প্রেষণে নিয়োজিত শিক্ষকরা উচ্চ আদালতে মামলা করে। ফলে সেখানে আর আলাদা করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ থাকেনি।

বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব ও সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি আরও বলেন, ‘একই পদে নিয়োগ পেয়ে পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক পদোন্নতি পেয়েছেন।  এখন প্রেষণে নিয়োগ দিয়ে চালানো হচ্ছে। অথচ সেখানে নতুন করে নিয়োগের চেষ্টা চালানো হয়েছিল। শিক্ষকরা মামলা করে তা বন্ধ রেখেছেন।’

এদিকে, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের বিভাগীয় প্রার্থিতা বাস্তবায়ন পরিষদের পক্ষে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর সম্প্রতি একটি আবেদন করা হয়েছে। সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক মো. কবির মোল্লা বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের গেজেটেড অফিসার ও নন-গেজেটেড কর্মচারীদের নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৫ (সংশোধনী ২০২০)’ খসড়ায় প্রধান শিক্ষক, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, সহকারী ইনস্ট্রাকটর, ইনস্ট্রাকটর পদে পদোন্নতিসহ প্রাথমিকের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন পদে পদোন্নতির ব্যবস্থা রাখার দাবি জানিয়ে আবেদন করা হয়েছে।