বস্তির শিশুদের গ্রহণশক্তি গড় শিশুদের চেয়ে বেশি

ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে বাস। ওই ঘরে পৌঁছে না সূর্যের আলো। দারিদ্র্যের দেয়াল ভেদ করে প্রবেশ করে না দিগন্তের বাতাস। এমন ঘরে বাস করা বস্তির শিশুদের সবচেয়ে বড় আশ্রয় খোলা আকাশ। সারাদিন এ গলি থেকে ও গলি হেঁটে-দৌঁড়ে গঠিত হয় ওদের পেশি। গঠিত হয় ওদের মগজ, মনন। আর সব শিশুদের মত বেড়ে উঠার সুযোগ না পেলেও মেধাশক্তি বেঈমানি করেনি এই বস্তির শিশুদের সঙ্গে। গড়পড়তা মধ্যবিত্ত বাঙালির সন্তানদের চেয়ে বস্তির ছেলেমেয়েদের গ্রহণশক্তি অপেক্ষাকৃত বেশি। 

নব্বইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বস্তির শিশুদের জন্য এক অনানুষ্ঠানিক স্কুল পরিচালনাকালে এমন অভিজ্ঞতা আহমদ ছফার। সেই অভিজ্ঞতা ‘সংকটের নানান চেহারা’ বইয়ে ‘অনানুষ্ঠানিক শিশুশিক্ষা প্রসঙ্গে’ রচনায় বর্ণনা করেন। গত দুই দশক ধরে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্কুল পরিচালনাকারী বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিও বলছেন একই কথা। 

‘অনানুষ্ঠানিক শিশুশিক্ষা প্রসঙ্গে’ রচনায় তার অভিজ্ঞতা ও বোঝাপড়া সম্পর্কে আহমদ ছফা বলেন, “এই স্কুল চালাতে গিয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেগুলাে আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ মনে করি। এই অভিজ্ঞতার আলােকে আমাদের দেশের অবহেলিত শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বৃহত্তর অর্থে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হই।... বস্তির শিশুদের লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে যে জিনিসটি আমাদের সর্বপ্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটি হল বস্তির শিশুদের গ্রহণশক্তি গড়পড়তা মধ্যবিত্ত শিশুদের চেয়ে অনেক প্রখর। শেখানাের পদ্ধতিটি যদি আনন্দদায়ক হয়, তাহলে তারা খুব তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করতে পারে।” 

ছফা বলেন, বস্তির শিশুদের নিয়ে আমরা একটা ফুটবল টিম করেছিলাম। আমাদের অভিজ্ঞতা এই যে, ওই বয়সের মধ্যবিত্ত শিশুদের চেয়ে তারা অনেক বেশি চৌকষ । আমরা যে শিশুদের লেখাপড়া শেখাতাম তারা ছিল একেবারে বিত্তহীন মা-বাবার ছেলেমেয়ে। এই শিশুরা নিজেরাই নানারকম কাজকর্ম করে মা-বাবাদের সাহায্য করত। কেউ রাস্তায় ছেঁড়া পুরনাে কাগজ কুড়াত, কেউ লােহালক্করের টুকরাে সংগ্রহ করত। আবার কেউ নিউমার্কেট অঞ্চলে মিন্‌তির কাজ করত। এরকম নানাধরনের কাজ করে শিশুরা দৈনিক ৮/১০ টাকা উপার্জন করত।” 

রচনায় উল্লেখ করা হয়, “আমাদের দেশের প্রাইমারি স্কুল গুলোতে যে পরিমাণ ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বছরে গিয়ে দেখা যায় তার পরিমাণ অর্ধেকে চলে এসেছে। সংখ্যাটি হ্রাস পাওয়ার একটি কারণ এই যে, শিশুদের বাবা-মাকে নানাকাজে সহায়তা করতে  হয়। ছেলেদের বাবার জন্য মাঠে ভাত নিয়ে যেতে হয়, হুঁকোটি দিয়ে আসতে হয়, গরু রাখতে হয় এবং মেয়েদের মাকে রান্নাবাড়ার কাজে সাহায্য করতে হয়। যেহেতু বেশির ভাগ মা-বাবা অভাবি, ছেলে-মেয়েদের দিয়ে এসব কাজ না করিয়ে তারা পারে না। তাই ছেলে-মেয়েদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনতে হয়। স্কুলে যদি ছেলে- মেয়েদের কোন কাজের ব্যবস্থা করা হত, যেগুলাে করতে শিশুদের বিশেষ বেগ পেতে হত না, বরং শরীর গঠনের সহায়ক হত এবং সপ্তাহ কিংবা মাসঅন্তর শিশুদের কিছু টাকা শ্রমের মূল্য হিসাবে পরিশোধ করা হত, আমার বিশ্বাস, অভিভাবকরা তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিতেন না। অবশ্য স্কুলের পরিচালনা ব্যবস্থাটির মধ্যে একটি সৃষ্টিশীল সংস্কার সাধনের প্রয়োজন ছিল।”

বস্তির শিশুদের মেধাশক্তি সাধারণ গড়পড়তা ছেলেমেয়েদের চেয়ে বেশি বলে মনে করেন রাজধানীর রায়েরবাজার বস্তি, করাইল বস্তি এবং চাঁদপুরে রেলওয়ে কলোনি সংলগ্ন বস্তি এলাকায় স্কুল পরিচালনাকারী কয়েকটি সংগঠন। এমনই একজন সংগঠক-শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, “নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বড় হওয়া এই শিশুরা অনেক কঠিন বিষয় সহজে গ্রহণের সাহস ও ক্ষমতা রাখে। লেখাপড়ার বিষয়গুলো শুরুতে তারা বুঝতে দেরি করলেও যখন বুঝতে শুরু করে তখন অসাধারণ গতিতে এগোয়।” 

তবে অনেক অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ধারা ও পদ্ধতিতে গলদ আছে বলেও মনে করেছিলেন আহমদ ছফা। ১৯৯৩ সালে লিখিত ওই রচনায় ছফা বলেন, “অবহেলিত শিশুদের জন্য অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা পদ্ধতি নামে যে জিনিসটি চালু হয়েছে সে বিষয়ে কিছু কথা আমি নিঃসংকোচে বলতে চাই। ব্র্যাক এবং অন্যান্য সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করার নাম করে যে ধরনের শিক্ষা দিয়ে আসছেন তা আমাদের দেশের গােটা শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে না বলে আমি মনে করি। প্রথমত, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার প্রয়ােজন আদৌ আছে কিনা সেকথাটিও গভীরভাবে চিন্তা করে দেখার দাবি রাখে । এই সেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ যেভাবে অতিদ্রুত বিদেশি অনুদানের অর্থের বলে শিশুদের শিক্ষিত করে তুলতে চান, সেটা আদৌ মেনে নিতে আমি ভয়ানক আপত্তি করব।

দ্বিতীয়ত, আপত্তি করবে তাদের পাঠ্যপুস্তকসমূহের কারণে। এই দেশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি শিশুশিক্ষার উদ্দেশ্যে যথেষ্ট শ্রম এবং প্রযত্ন ব্যয় করেছেন। তাছাড়া আমাদের দেশের মক্তব-মাদ্রাসা , টোলসমূহের শিক্ষাদান পদ্ধতিসমূহকে পাশ কাটিয়ে আনকোরা একটি নতুন পদ্ধতি চাপিয়ে দিলে কোন ফল পাওয়া যাবে তা মনে করার কোন কারণ নেই।

তৃতীয়ত, যে কারণে আমি আপত্তি করব সেটা হল এই পাওলাে ফ্রেইরির শিক্ষা পদ্ধতি বলে যে জিনিসটি এখনাে চালানাে হচ্ছে, তাতে পাওলাে ফ্রেইরির শিক্ষাদর্শন এবং শিক্ষারচিন্তার কোন প্রতিফলন নেই।

পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষা দর্শনের মূলকথা হল শিক্ষা একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া এবং এতে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী সমানভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। তাছাড়াও পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের গতি-প্রকৃতির একটি অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বর্তমান। এখানে সেটি মােটেই ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না। এ সমস্ত প্রচেষ্টার মধ্যে ভাবের ঘরে চুরি বলে যে একটি কথা আছে সেটি অহরহ ঘটছে। দাতা দেশগুলাে বুঝতে পারছে না তাদের সহায়তার ফলে বাংলাদেশের শিক্ষার আশানুরূপ উন্নয়ন ঘটছে না এবং গ্রহীতা দেশও উচ্চকণ্ঠে বলতে পারছে না, বিদেশের সাহায্য অর্থবহ করে তােলার জন্য ভিন্নরকম পন্থা এবং পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়ােজন। এই ভিন্নরকম পদ্ধতিটির চেহারা কি রকম হবে আমি বলতে পারব না। অবহেলিত শিশুদের শিক্ষিত করে তােলার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যা সবাইকে গ্রহণ করতে হবে।

মানুষ যে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এতদূর উন্নতি সাধন করেছে তার মূল কারণ শিক্ষা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মানুষের শিশুকে শিক্ষা দেয়ার পদ্ধতি অনেক বেশি ধৈর্য ও পরিশ্রম সাপেক্ষ এবং যথেষ্ট পরিমাণে ধীরগতিসম্পন্ন।”