করোনা ও আমাদের প্রস্তুতি

মোঃ মুনসুর আলম
মোঃ মুনসুর আলম

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বব্যাপী মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার সক্ষমতা বিশ্লেষণ করতে হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান দুই ধাপ এগিয়েছে। ১৯৩টি দেশের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৪১তম, যেটা গত বছর ছিল ৪৩তম। আর ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩০তম। ৭ জানুয়ারি ২০১৯ লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্সের (সিইবিআর) প্রকাশিত রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতিতে এবারও প্রথম অবস্থান ধরে রেখেছে। আর চীন রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের দিক দিয়ে এ দুটি দেশ এখন (০৪/০৪/২০ইং) যথাক্রমে ১ম ও ৫ম । পৃথিবীর অন্যান্য অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ জাপান,জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি ইত্যাদি দেশসমূহে করোনার প্রকোপ তীব্রতা লাভ করায় আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ করোনা মোকাবেলা করতে কতটা সক্ষম হবে তা আজ ভেবে দেখার বিষয়।

শক্তিশালী অর্থনীতি ও প্রযুক্তিনির্ভর দেশগুলোতেই আজ লাশের মিছিল। এ মিছিলে অবস্থান করে কেউ কারোদিকে কর্নপাত করার শক্তি পাচ্ছে না। প্রায় সকল দেশই মানবিক বিপর্যয়রোধের পাশাপাশি অর্থনীতির স্বভাবিক গতি ধরে রাখার কৌশলে ব্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে শুধু জাতীয় শক্তি দিয়ে করোনাকালীন ও করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয়। করোনার বিরুদ্ধে সারাপৃথিবীকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে । আর যেকোনো মহা দুর্যোগ বা মহা যুদ্ধের পর পৃথিবীর অর্থনীতি ও প্রকৃতি নতুন করে রুপ ধারন করে। তাই যেসব দেশ করোনা মোকাবেলা করছে তাদেরকে অবশ্যই করোনাকালীন পরিস্থিতির সাথে সাথে করোনা পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বিশেষকরে উন্নয়নশীল দেশসমুহকে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে কারন মহা বিপর্যয়ের পর উন্নয়নশীল দেশসমূহই উন্নত দেশসমূহের ক্রীড়ানকে পরিনত হয়। তাই এ মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত এবং সক্ষম তা সময় বলে দিবে। কারন এ দুর্যোগের শেষ কোথায় তা এখন বলা কঠিন।

পৃথিবীর উন্নত দেশ গুলো এ মহামারী ঠেকাতে পারছে না। ৪র্থ অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্র জার্মানির অর্থমন্ত্রী এ বিপর্যয় মোকাবেলা করার আতংকে আত্মহত্যা করেছেন। এটাকে শুধু কাপুরুষোচিত ক্রিয়া ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন জনগণের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষনে মার্কিন অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন এবং করোনা পরবর্তীতে কিছু লোকের আত্মহত্যা করার কারণ উল্লেখ করেছেন। সেখানে আমাদের দেশের সরকারের পক্ষে এককভাবে শুধু জাতীয় শক্তি দিয়ে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করা অত্যন্ত কঠিন। আমরা করোনা মোকাবেলায় কোন কৌশল অবলম্বন করবো বা কোন দেশকে অনুসরণ করবো তা এখন নির্ধারণ করা জটিল ব্যাপার। তাই এই দুর্যোগের গতি অবলোকন করার জন্য সচেতনভাবে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় কোনো রাষ্ট্রের নেই। এ বিপর্যয় শেষ কখন হবে তা অনুমেয় নয়। তাই জনগণকে বিশেষকরে নিম্ন আয়ের লোকদের কিভাবে লকডাউনে রাখা যায় সেদিকে সরকারকে তার আর্থিক সক্ষমতা অনুযায়ী সিন্ধান্ত নিতে হবে। অন্যথায় অন্নহীনভাবে জনগনকে ঘরে রাখা যাবে না। পেটের তাগিদে কর্মহীন মানুষগুলো ঘর থেকে বের হয়ে যাবেই। যার ফলে বাংলাদেশকে ইউরোপের দেশগুলোর পরিনতি ভোগ করতে হতে পারে। আর সত্যি হতে পারে বাংলাদেশকে নিয়ে জাতিসংঘের সম্ভাব্য রিপোর্ট যাতে বলা হয়েছে ২ থেকে ২০ লক্ষ লোক মারা যাবে।

আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ঘনবসতি, জনগণের অসচেতনতা, ধর্মীয় গোড়ামি, দারিদ্র্য এবং উপযুক্ত নীতির অভাব। এ সংকটে Stay home নীতি অনুসরণ করে আমরা কতদিন সেইফ থাকতে পারবো। বর্তমানে করোনায় আক্রান্তের দিক দিয়ে প্রথম দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বর্গকিলোমিটারে যেখানে বসবাস করে ৩৩ জন সেখানে বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১২৬৫ জন। কিন্তু আশার কথা হলো এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে করোনার বিস্তার অন্যান্য দেশের চেয়েও ধীর গতি। আর হতাশার বানী হলো এ গতি কতোদিন ধীর থাকবে? করোনা দেশ-জাতি-ধর্ম-বর্ন কিছুই মানছে না। যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে সংক্রমন ঘটাচ্ছে। তাই পৃথিবীর প্রায় রাষ্ট্র লোকসমাগমরোধে যেকোনো সিন্ধান্ত নিচ্ছে। মুসলমানদের তীর্থস্থান কাবা শরীফ তাওয়াফ করাও স্থগিত রাখা হয়েছিল এবং এবছর হজ্ব পালন করা হবে কিনা এ বিষয়ে সৌদি সরকার এখনো সিন্ধান্ত নিতে পারেনি । অথচ বাংলাদেশে আগের চেয়েও মসজিদে লোক সমাগম বেশি হচ্ছে। মসজিদে না এসে বাসায় নামাজ পড়া যাবে কিনা এ বিষয়ে বাংলাদেশের আলেম সমাজ দুইভাগে বিভক্ত। সরকারও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয় চিন্তা করে এ ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। দিল্লিতে তাবলীগের জামাতে সমাগমের কারনে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তারা এটিকে বহন করছে বলে ভারতীয় গনমাধ্যম দাবী করছে। তাহলে বাংলাদেশে এটা কেমন আকার ধারন করতে পারে এবং এর দায়ভার কে নিবে? কারন বাংলাদেশে এটি ইতোমধ্যে কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আবার দরিদ্র্যতা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

কর্মহীন মানুষকে কোয়ারান্টাইনে রেখে আর্থিকভাবে সাহায্য করে কতদিন চালিয়ে যাওয়া যাবে তা বলা কঠিন বিষয়। ইতোমধ্যে রেমিট্যান্স কমে গেছে। মিল কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। মোটামুটি অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত। এ অচলাবস্থার ধকল সহ্য করার আর্থিক ক্ষমতা আমাদের কতদিন থাকবে। দেশকে যত তাড়াতাড়ি করোনামুক্ত করা যায় ততই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য মঙ্গলজনক। তাই সরকারের পাশাপাশি সকলেই এগিয়ে আসতে হবে। গড়ে তুলতে হবে জাতীয় ঐক্য এবং নিতে হবে সম্মিলিত পদক্ষেপ।

লেখক : প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, সাতকানিয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।