বুক রিভিউ: হুমায়ূন আহমেদের ‘আমার ছেলেবেলা’

‘আমার ছেলেবেলা’ হুমায়ূন আহমেদের আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ। যে কোনো আত্মজীবন পেলেই লুপে নিই। আত্মজীবনী পড়ে কিছু শিখা যায়। নিজের মধ্যে নমনীয়তা আসে। মহান ব্যক্তি যদি এমন হতে পারে, এতো কষ্ট সহ্য করতে পারে, তাহলে আমি কে? আমি কেন পারবো না? ঠিক এ ধরণের উপলদ্ধিতে আত্ম অহংকার বোধ কমে, ধৈর্য বাড়ে। তারমধ্যে যদি হয় হুমায়ূন আহমেদের ছেলেবেলা! তাহলে লোভ সামলায় কি করে?

কথা সাহিত্যের নান্দনিক নাম হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদ তার জাদুকরী লেখা দিয়ে সব পাঠকের মতো আমার মনেও দারুণ প্রভাব ফেলেছে। তবে অন্যদের চেয়ে আমার মধ্যে একটু বেশিই ফেলেছে। তার কারণ, জীবিতকালে আমি তার সাথে নয় এমনকি তার লিখিত রসবোধ সাহিত্যের সাথেও পরিচিত ছিলাম না। সাহিত্য কি তা তখন বুঝতাম না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে উঠেপড়ে লেগেছিলাম তখন। আর এখন একনাগাড়ে তার বই পড়ায় প্রভাবটা একটু বেশিই পড়েছে। এসব আমার ভূমিকা।

হুমায়ূন আহমেদ ‘আমার ছেলেবেলা’ বইয়ের ভূমিকায় ছেলেবেলার কথা লিখার কৈফিয়তটি দিয়ে দিলেন এভাবে—‘দুপুরে খেতে বসেছি। খাওয়ার সময় আমার মেঝ মেয়ে মায়ের সাথে রাগারাগি করে খাবার গ্রহণ বন্ধ করে দিলেন। অনেক সাধাসাধি করেও তাকে খাওয়ানো যাচ্ছে না। তাই আমি একটি প্রস্তাব দিলাম তাকে।’

কি সুন্দর পদ্ধতি। বাবা রেগে যাওয়া মেয়েকে ভাত খাওয়ানোর ফন্দি বের করলেন। বললেন, তোমাকে আমার ছেলেবেলা একটি গল্প বলবো— যদি তুমি গল্প শোনে হেসে ফেল তাহলে হেরে যাবা। না হেসে থাকতে পারলে জিতে যাবা। আর হেরে গেলেই ভাত খেতে হবে। এ কেমন বাবা! আমাদের গ্রামে গঞ্জের রাক্ষুসে টাইপের বাবা হলে চোখ লাল করে বলতো— এক্ষুনি খাবি, তুর মা খাবে, তুর নানা খাবে। তুর চৌদ্দগুষ্টি শুদ্ধা খাবে। বাহ! মানুষ খাইতে পাই না আর তুই?

সাহিত্যিক বাবার ছোটবেলার গল্প শুনে মেয়ে হেসে ফেললেন। অতঃপর ..! এখান থেকে তার ইচ্ছে জাগল ছেলেবেলার গল্প লিখবেন। যে পরিকল্পনা সেই কাজ।

লেখক শুরুতে ‘শোনা কথা’ শিরোনামে একটি পর্ব লিখছেন। তাতে এমন গল্পকে স্থান দিয়েছেন যা জন্মের পর পৃথিবীর কোনো শিশুরই জানার কথা না। যেমন কিভাবে জন্ম হলো। জন্মের পর কাঁদলেন না হাসলেন এসব। তুলে আনলেন ডাক্তার কিংবা ধাইয়ের কথা। সে সময়কার ধাইয়েরা কোনো কোনো ডাক্তারের চেয়েও ভয়ংকর হতো। যত্তোসব কুসংস্কার তারা লালন করে আপন আপন সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিত। তেমন একটি কথাও লেখক ‘শোনা কথা’ পর্বে উল্লেখ করেছেন- জন্মের পর শিশুকে কাঁদতে হয়। না কাঁদলে অমঙ্গল হয়।

লেখকের জন্মের পর সে কাঁদছে না বলে ধাই ঠাস করে শিশুর গালে বসায় দিলেন এক চড়। লেখক বলল, ‘আমি জন্ম মুহূর্তে মানুষের হৃদয়হীনতার পরিচয় পেয়ে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলাম।’ তৎকালীন সমাজে বিদ্যামান নারী পুরুষের বৈষম্যের একটি চিত্রও তুলে ধরছেন এভাবে— আমার কান্না শুনে নানা ছুটে আসল। জানতে চাইলেন ছেলে নাকি মেয়ে? ধায় দুষ্টুমি করে বলল, মেয়ে। নানা সাথে সাথে বাজারে লোক পাঠালেন। বললেন, আধামণ মিষ্টি নিয়ে আসো। পরে যখন জানলেন মেয়ে নয়, বরং ছেলে তখন আবার লোক পাঠালেন, বললেন, আধামণ নয় একমণ মিষ্টি নিয়ে আস।

বিশেষভাবে তুলে এনেছেন তাঁর অসাধারণ বাবার কথা। লেখকের পরিবারের প্রায়ই সাহিত্যিক এবং সাহিত্যপ্রেমী। এ হয়তো তাদের জিনগত কারণ। বাবা ফয়জুর রহমান ছিলেন অসাধারণ সাহিত্য প্রেমী একজন মানুষ। লেখক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার সাহিত্যপ্রেমী বাবার অনেক কথায় তুলে ধরেছেন নিজের ছেলেবেলার এ বইতে।

হুমায়ূন আহমেদের নানা তার মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করলে এক উকিল বিএ পাস বেকার ছেলে ফয়জুর রহমানের প্রস্তাব নিয়ে যায়। মেয়ের বাবা জানতে চায় ছেলে কি পাস? বলে বিএ পাস। করে কি? বলে, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য পাঠাগারে বসে বসে সারাদিন বই পড়ে। বলল, কেন? উকিল বলে, বেকার, চাকরি নাই।

বিয়ে হয়ে যায়, পুলিশের চাকরি হয় একসময়। তারপরও লেখকের বাবা ডিউটির পর সময়টা লাইব্রেরিতে কাটান। হুমায়ূন আহমেদ বলেন, বাবার অসুখের জন্যে অপেক্ষা করতাম আমরা। কারণ, বাবার অসুখ হলেই বাবা ঘরে থাকতেন এবং তার ছেলে মেয়েদেরকে নিয়ে গোল করে বসে কবিতা পাঠ চর্চা করতেন। ছেলেমেয়েরদেরকে উচ্চস্বরে কবিত আবৃত্তি করতে দিতেন। এতে নাকি তার আরাম বোধ হয়। একবার বাবার এমন জ্বরের সময় বাবা ঘোষাণা করলেন, সঞ্চয়িতা থেকে একটা কবিতা মুখস্থ করে তাকে যে শোনাতে পারবে তাকে এক আনা এবং যে দুইটি কবিতা শোনাতে পারবে তাকে দুই আনা পয়সা দেয়া হবে।

এ ঘোষাণায় হুমায়ূন তার বাবার প্রিয় ‘এবার ফিরাও মোরে’ নামক একটা দীর্ঘ কবিতা মুখস্থ করে শোনালেন। বাবা খুশি হয়ে তাকে চার আনা পয়সা দিয়ে দিলেন। বাংলাদেশে যে বই সর্বোচ্চ বিক্রি হয় সেই সর্বোচ্চ বিক্রিত বইয়ের লেখক হুমায়ূন আহমেদ আত্মতৃপ্তিতে বললেন, ‘সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ড থেকে ওটাই ছিল আমার প্রথম রোজগার।’

পুলিশরে চাকরি। বেতন ছিল আশি টাকা। সেই আশি টাকা বেতন থেকে বাড়িতে পাঠানোর টাকা ও বই কেনার টাকা আলাদা করে রেখে দিয়ে বাকি টাকা সংসার চালানোর জন্য স্ত্রীর হাতে দিতেন সাহিত্যপ্রেমী ফয়জুর রহমান। স্ত্রীও টেনেটুনে কষ্ট করে সংসার চালাতেন। যেখানে বাবার কোনো হাত ছিল না। এ কেমন বই প্রেমী!

মৃত্যুকালে মানুষ অনেক কিছু রেখে যায়। হুমায়ূনের বাবা মৃত্যুকালে সম্পদ বলতে যা রেখে গেছেন তা হলো তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে থাকা চার হাজারেরও বেশি বই। ছোট্টকালে তার পড়ালেখা বিষয়ে চমৎকার একটি তথ্যও দিয়েছেন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। নিজেই উল্লেখ করেছেন ছোটকালে খুবই দুষ্ট প্রকৃতির এবং বদমেজাজি টাইপের ছিলেন তিনি। পাঠশালায় ভর্তি হলে দুষ্টুমির দায়ে সারাদিন কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো তাকে। বাবা এ নিয়ে কোনো ধরণের চাপচাপি বা শাসন করতেন না।

বর্তমান আমাদের সমাজে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার বানানোর প্রত্যাশী মা বাবারা নিজেদের কচিকাঁচা ছেলে মেয়দেরকে যেভাবে কাঁধে বইয়ের ব্যাগ তুলে দিয়ে স্কুল, কোচিং এবং গৃহশিক্ষকের কাছে বন্দি করে মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে তাতে যতটুকু ফায়দা হচ্ছে মনে করছে আমার দৃষ্টিতে তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে। কারণ, মানসিক চাপ ও সময়ের কাছে বন্দী এসব শিশুরা কোনো এক সময় ছাড়া পেলেই পাগলা ঘোড়ার রূপ নেয়। ডেকে আনে বাবা মায়ের জন্যে অশনিসংকেত। বর্তমানের শিক্ষিত বাবা তাদের অহংকারী ছেলেমেয়েদের তুলনায় তৎকালীন শিক্ষিত বাবা ও তার ছেলে পরবর্তীতে দেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন কেমন ছিলেন! জানলে অবাক হবেন আপনিও। লেখকের জবানিতে বলি—

‘সামনে পরীক্ষা। পড়ায় মন বসছে না। মা বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে পড়ছেন। এখন আর পড়তে বলে না। এক প্রকার স্বাধীন আমি। এমন সময় আমার বন্ধু মাথা মোটা শংকর দৌড়ে দৌড়ে আসে আমার কাছে। বলে, আমি পাস করতে পারলে মা একটি চামড়ার বল কিনে দিবে বলছে। তুই আমাকে যেকোন উপায়ে পাস করা। এখন কি করবো? তাকে পাস করাতে হলে, বুঝাতে হবে। তাকে বুঝাতে গেলে নিজেকেও পড়তে হবে। পড়া তো ভালো লাগে না। অন্যদিকে বল লাগবে আমাদের। লেগে গেলাম পড়ায়। তাকেও পড়াতে লাগলাম। বাড়ির সবাই অবাক।

যথারীতি পরীক্ষা দিলাম। ফলাফল বের হলো। দেখা গেল আমার বন্ধু শংকর ফেল। তাকে পাস করানো গেলো না। এবং সব শিক্ষকদেরকে চমকে দিয়ে আমি ফার্স্ট হয়ে গেলাম। রেজাল্ট কার্ড নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফিরলাম। আমার কাঁদার কারণ, জানতে পেরে বাবা হেসে অস্থির। অনেকদিন পর্যন্ত আমার কান্নার এ গল্প বাবা মানুষজনদেরকে বলতো, আমার ছেলের কাণ্ড দেখছো পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলো। কেন কাঁদছে জান? তার বন্ধু ..!

অভাবী সংসারে জন্মদিন পালন করা হতো না। বন্ধুর জন্মদিন পালন হচ্ছে দেখে ছোট বোন শেফা এবং লেখক বাবার কাছে বায়না ধরলো। বাবা বলল, জন্মদিন শুধু একবার পালন করতে পারবো। তবে তোমরা এমনভাবে বড় হও যেন সব মানুষ তোমাদের জন্মদিন পালন করে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একবার পালন করা জন্মদিনে মেয়েকে ভালোকিছু উপহার দিলেও ছেলে হুমায়ূনকে দিল একটা বাঁধানো ফ্রেমে দীর্ঘ একটি কবিতা। যার প্রথম দু'টি চরণ ছিল এমন—

‘সাতটি বছর গেল পরপর আজিকে পরেছো আটে,
তব জন্মদিন নয়ত মলিন ভয়াল বিশ্ব হাটে’

লেখকের বই পড়ার শুরু নিয়েও একটি চমৎকার গল্প এনেছেন। ছোট থাকতে হাঁটতে হাঁটতে গেইট খোলা পেয়ে একটি স্বপ্নের কুটিরে ঢোকে পড়েন। কিছুক্ষণ পর একটি মেয়ে নেমে আসে। কথাবার্তার পর তাকে একটি মিষ্টি ধরিয়ে দেয়। পরদিন আবার যায় আবার মিষ্টি পায়। একদিন ছোট বোনকেও নিয়ে হাজির হয় স্বপ্নের কুটিরে। কারণ, ছোটবোন মিষ্টি পছন্দ করতো। স্বপ্ন কুটিরের মেয়েটি সেদিন মিষ্টি দিতে পারে না। মিষ্টি ছিল না বাসায়। তাই একটি বই ধরিয়ে দেয়।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'ক্ষীরের পুতুল' নামে চমৎকার একটি বই। সেই বই থেকে বইপ্রেমী হয়ে ওঠেন লেখক। চুরি করে করে বাবার লাইব্রেরি থেকে বই পড়তেন। একদিন ধরা পড়ে যায় বাবার হাতে। ভয়ে কাঁতর। বাবা কি শাস্তি দেয় জানে এমন আতঙ্ক। বাবা বলল, এসব পড়িছ?
বুঝিছ কিছু?

তারপর বলল, চল। কাপড় পরে একটি রিক্সা নিয়ে চলে যায় কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য পাঠাগারে। সদস্য বানিয়ে দেয় ছেলেকে। এরপর থেকে শুরু হয় বই পড়া। দৈনিক দু’টি করে বই। লাইব্রেরিয়ান বিরক্ত হয়ে পড়ে। মা বিরক্ত হয়ে পড়ে। চোখের আলো লোপ পায়।

এ হলো কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ছেলেবেলার কিছু অংশ। লেখক অন্যান্য সাহিত্যের ন্যায় এ বইটাও খুবই রসবোধ এবং চমৎকার বর্ণনা দিয়ে সাজিয়েছেন। তুলে ধরেছেন বিভিন্ন মানুষের কষ্টের কথা। তার জীবনস্মৃতি ও বাবার চাকরির সুত্রে বিভিন্ন জেলায় অবস্থান করার অভিজ্ঞতা। ৯৪ পৃষ্ঠার এ ছোট্ট বইটি চাইলে আপনিও পড়ে ফেলতে পারেন।

লেখক: ছোট গল্পকার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী