ইমাম হুসাইনের হত্যাকাণ্ডে একজন কথিত আলেমের ফতোয়া

মো. আবু রায়হান
মো. আবু রায়হান

মুসলিম বিশ্বে চলছে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ও শোকের মাস মহররম। আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশত বছর পূর্বে ৬১ হিজরি মোতাবেক ১০ মহররম ইরাকের ফোরাত নদীর কুলে কারবালার প্রান্তরে আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদরের দৌহিত্র হযরত হযরত হুসাইন (রা.) সেদিন সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন। ইসলামী রাষ্ট্রে রাজতন্ত্রের প্রবক্তা হযরত আমির মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তার পুত্র এজিদ ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খিলাফতের খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। এজিদ ছিল দুশ্চরিত্রের অধিকারী, লম্পট, দুরাচার, মদ্যপানে আসক্ত। সে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্রে অনৈসলামিক বিধিবিধান চালু করে। তার এমন আচরণে মুসলিমবিশ্ব বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেই সময় হযরত হুসাইন সত্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী খিলাফতের পবিত্রতা রক্ষায় ইসলামের ঝান্ডা নব উদ্যমে উড্ডীন করেন। এদিকে উৎকোচ, ভয়ভীতি প্রদর্শন, পদ পদবী ও লোভনীয় সুযোগ সুবিধা দিয়ে এজিদ সিরিয়া, বসরা, কুফায় তার পক্ষে একটি অনুগত সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করে।

হযরত হুসাইন সেই সময় মক্কা মদিনায় অবস্থান করছিলেন। হযরত হুসাইন এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়েছেন শুনে কুফার অধিবাসিরা তাঁকে ইসলামী খিলাফতের পবিত্রতা রক্ষার জন্য নেতৃত্ব দেয়ার ও ইসলামী খিলাফত পুনর্জাগরণের মাধ্যমে মদ্যপ, জুয়াড়ি ও ব্যভিচারী এজিদের অপসারণ চেয়েছিল।কুফাবাসী এজিদের প্রজা ও অনুগত হওয়ার কলঙ্ক থেকে মুক্তি দেয়ার সংগ্রামে হুসাইনকে নেতৃত্ব দিতে অসংখ্য পত্র দিয়েছিল।এক হিসেবে পাওয়া যায় কুফাবাসী’র পক্ষ থেকে প্রায় ১৮ হাজার পত্র হযরত হুসাইনকে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি পত্রের মধ্যে ১০০ জনের স্বাক্ষর ছিল। কিন্তু প্রয়োজনের সময় কুফার খুব কম লোকই তাঁকে সহযোগিতা করেছিল। ফলে এজিদের বাহিনীর প্রায় ৩০ হাজার সদস্যের সুসজ্জিত সৈন্যের বিরুদ্ধে প্রায় ১০০ থেকে ১৪০ জন সঙ্গী নিয়ে হুসাইন বীর বিক্রমে লড়াই করে শহাদতের পেয়ালা পান করেন।হযরত হুসাইনকে কুফাবাসিরা পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সহযোগিতা না করা প্রসঙ্গে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে।

কুফায় নিযুক্ত এজিদের নরপিশাচ গভর্নর উবাইদুললাহ ইবনে জিয়াদ সেই সময়ের দরবারি আলেম ও প্রধান বিচারপতির কাজি শুরাইহর কাছ থেকে একটি ফতোয়া নেন। যে ফতোয়ায় হযরত ইমাম হুসাইনকে হত্যার জন্য কুফার জনসাধারণকে উস্কানি দেওয়া হয়েছে।ইবনে জিয়াদের আদেশে তৈরি করা কাজী শুরাইহ এর সেই ফতোয়ায় বলা হয়েছিল হযরত হুসাইন তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের খলিফা ও 'আমিরুল মুমিনিন' এজিদের আনুগত্য গ্রহণ করেননি, তাই তাকে দমন করা তথা তার রক্তপাত ঘটানো মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব।

কুফার মসজিদে ইবনে জিয়াদ এই ফতোয়া জনগণকে শুনিয়ে হুসাইনের বিরুদ্ধে জনগণকে উত্তেজিত করে তোলে। ইবনে জিয়াদ কুফার মসজিদে সমবেত জনগণকে এই বলে হুমকি দেয় যে, জনগণকে হয় হযরত হুসাইনের বিরুদ্ধে সৈন্য দলে যোগ দিতে হবে অথবা মৃত্যু-বরণ করতে হবে। এই দুটোর মধ্যে যে কোনো একটি পথ তাদের বেছে নিতে হবে! তারা যদি হযরত হুসাইনের বিপক্ষে যুদ্ধ করে তবে তাদের পুরস্কৃত করা হবে বলেও ইবনে জিয়াদ ঘোষণা দেয়।

তৎকালীন কুফার ১৩ হাজার বিভ্রান্ত উদ্ভ্রান্ত মুসলিম হযরত হুসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ওমর সাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। এদের মধ্যে সিমার বিন জিল জুশান ছিল সদ্য যোগ দেওয়া ১৩ হাজার সৈন্যের চারজন টিম লিডারের অন্যতম।

হযরত হুসাইনের নেতৃত্বে কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা খোদাদ্রোহী ও মুনাফিক চরিত্রের অধিকারী উমাইয়া শাসক এজিদের স্বরূপ ও কুৎসিত চেহারার মুখোশ উন্মোচন করেছিল। ইসলামের নামে ধর্মান্ধতা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ চালু করেছিল এজিদ শাসক গোষ্ঠী। উমাইয়াদের রাজতান্ত্রিক ইসলামে বসেছিল দরবারি, পকেট আলেম তথা স্বার্থলোভী আলেমদের মেলা। তারা হাজার হাজার জাল হাদিস প্রচার করে ইসলাম সম্পর্কে ধুম্রজাল ও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। ইসলামের খাঁটি অনুসারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা ও কপট প্রকৃতির নেতাদের মাহাত্ম্য প্রচার করা ছিল তাদের নিত্যদিনের রুটিন ওয়ার্ক।

এসমস্ত কথিত আলেমরা হযরত হুসাইন ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের ‘ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বলে প্রচার করেছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় হযরত ইমাম হুসাইনকে হত্যার জন্য উদগ্রীব সৈন্যদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল নামাজি। তারা চিৎকার করে বলছিল তাড়াতাড়ি হুসাইনের মাথা কাট, নামাজ বা জামায়াতে নামাজ আদায়ের সময় পার হয়ে যাচ্ছে!
এরা কি একবারও চিন্তা করেনি যে, রাসূল (সা.)’র আহলে বাইতের একজন মহান সদস্যকে তারা হত্যা করতে যাচ্ছে! তারাই আবার ঐ মুখে নামাজের কথা বলছে, কি দ্বিচারিতা, কপটতা, মুনাফেকি!

আইয়ামে জাহেলিয়াতের সেই বর্বরতার যুগেও যেখা‌নে আরব মুশরিক ও কাফিররা পবিত্র মহররম মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ করত না। সেখানে উমাইয়া খিলাফত আমলে মুসলিম নামধারী শাসকরা এতটাই হীন ও নীচ হয়ে গিয়েছিল যে তারা রাসূল (সা.) দৌহিত্র ও তাঁর পরিবারকে এই নিষিদ্ধ বা পবিত্র মাসেই নৃশংসভাবে শহীদ করতেও পিছপা হয়নি।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম সে যুগের উমাইয়া শাসকদের প্রকৃতি তুলে ধরেছিলেন এভাবে,

"ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ্। তখতের লোভে এসেছে এজিদ কমবখতের বেশে !
এসেছে সীমার, এসেছে কুফা'র বিশ্বসঘাতকতা,ত্যাগের ধর্মে এসেছে লোভের প্রবল নির্মমতা !
মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ, ...কাঁদে আসমান জমিন, কাঁদিছে মোহররমের চাঁদ।
একদিকে মাতা ফাতেমার বীর দুলাল হোসেনী সেনা,আর দিকে যত তখত-বিলাসী লোভী এজিদের কেনা।
এই ধুর্ত্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন,আলী'র সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান !
এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায় হাসানে হোসেনে গালি দিতে যেত মক্কা ও মদিনায়।"

সেদিনের সেই কথিত আলেম নামধারী কপট মুনাফিক আজও আছে। আছে কথিত মুসলিম যারা সুযোগ পেলেই সত্যের বিরুদ্ধে মিথ্যার পক্ষে লড়ে। সত্যকে গলাটিপে ধরে সুযোগ সুবিধার আশায় মিথ্যার বেসাতি গায়। পদলেহন করে স্বৈরাচার জালিম শাসকের। কারবালার ঘটনা শুধু আফসোস,অনুতাপ আর মাতমের দিন নয়। সত্যের দীক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে নিজেকে উৎসর্গ করার দিন।