উপাচার্য প্যানেল ২০১৯ ও নানা জিজ্ঞাসা

গত কয়েকদিন ধরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের বিশেষ অধিবেশনকে ঘিরে যে ধূম্রজাল সৃষ্টির প্রচেষ্টা দেখছি, তাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান সমুন্নত রাখতে কিছু তথ্য শেয়ার না করে পারছি না। আমরা শিক্ষকরা বড়ই অদ্ভুত এক পেশাজীবী শ্রেণী। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা প্রিন্ট কিংবা টিভি মিডিয়াতে একে অপরের চরিত্র হননে মেতে উঠি অবলীলায়। একজন গবেষক ও তার টিমকে যেমন আমরা ছাড় দেই না, তেমনি কলঙ্কিত করতে ছাড়ি না শিক্ষক নেতৃবৃন্দ এমনকি উপাচার্য বা প্রো-উপাচার্যকেও। আমরা ভুলে যাই যে প্রকারান্তে আমরা আমাদের এই প্রিয় বিদ্যাপিঠকেই উপহাস করি, সর্বসাধারণের কাছে করে তুলি পরিহাসের উপকরণে। দেখবেন, অন্য পেশাজীবীরা যেমন ডাক্তার, আমলা বা বিচারপতিরা কিন্তু পাবলিক ফোরামে একে অপরের পেছনে এমন গাট বেঁধে নেমে পড়েন না। তবে কি তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তাঁরা এটুকু বোঝেন যে ওপরের দিকে থুথু নিক্ষেপ করলে তা নিজের গায়েই এসে পড়ে। হায়! আমরা এটা কবে বুঝব?

যাই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি। গত ৩১শে জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের বিশেষ অধিবেশনের পরই যেমন চারদিকে ‘জাত গেল, জাত গেল’ শোরগোল উঠলো, তার পর প্রকৃত ঘটনা কি ঘটেছিল তা জানার কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারিনি। বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সাথে ক্লাবে, লাউঞ্জে, অফিসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। উনাদের কয়েকজন আবার সিনেট সদস্য হবার সুবাদে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।

মজাব ব্যাপার হল, ঘটনা একটি হলেও, প্রত্যেকেরই বিবরণ দেয়ার একটি নিজস্ব অ্যাংগেল থাকে যা তার মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফলে কেউ কেউ কোন কোন অংশকে বিশেষভাবে হাইলাইট করে কিংবা কোন কোন অংশকে এড়িয়ে যায় (হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবেই)। অনেকের সাথে একই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করার সুবিধা হলো, LEGO-র মত আপনি গল্পের বিভিন্ন অংশগুলো এঁর ওঁর বক্তব্য থেকে সংগ্রহ করে জোড়া দিয়ে ঘটনার প্রকৃত চিত্রটি ঠিকই বের করে ফেলতে পারবেন। তা আমার কাছে উঠে আসা ঐ দিনের ঘটনাটি মোটামুটি এরকম – 

প্রথমেই বলে রাখি, ঐ দিন ছিল সিনেটের বিশেষ অধিবেশন যেখানে একটি মাত্র এজেন্ডা ছিল উপাচার্যের প্যানেল নির্বাচন। সিনেটের অধ্যাদেশ অনুযায়ী এই অধিবেশনে যেকোন সিনেট সদস্য এক বা একাধিক ব্যক্তির নাম উপাচার্য হিসেবে প্রস্তাব করতে পারেন, যা অপর অন্তত একজন সদস্য সমর্থন করবেন। এক্ষেত্রে যার নাম প্রস্তাব করা হচ্ছে, তার লিখিত সম্মতিপত্র থাকতে হবে; ফলে প্রার্থীর লিখিত সম্মতিপত্র ছাড়া নাম প্রস্তাবের কোন সুযোগ নেই। প্রস্তাবিত নামসমূহ থেকে তিনজনের একটি প্যানেল তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের নিকট প্রেরণ করার বিধান রয়েছে। যদি তিনের অধিক নাম আসে, সেক্ষেত্রে সিনেটররা ভোটের মাধ্যমে তিনজনকে নির্বাচন করবেন।

যাই হোক, ৩১শে জুলাই বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে সিনেট অধিবেশন শুরু হয় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে। এরপর চারটি ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই চারজন শিক্ষক। অতপর, সিনেটের সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য প্রার্থীদের নাম আহবান করেন। তখন বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম তিনটি নাম প্রস্তাব করেন যা যথাক্রমে ১। অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান (বর্তমান উপাচার্য) ২। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুস সামাদ (বর্তমান প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন)) এবং ৩। অধ্যাপক ড. এ. এস. এম. মাকসুদ কামাল (শিক্ষক সমিতির সভাপতি)। অধ্যাপক শিবলীর বক্তব্যের মাঝখানে পয়েন্ট অফ অর্ডারে কিছু বলার আবেদন করেন সিনেটর অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আজিজ।

সভাপতি মহোদয় উনাকে বলেন যে নাম প্রস্তাব চলছে; অর্থাৎ এই প্রক্রিয়াকে বাঁধাগ্রস্থ না করার অনুরোধ করেন। অধ্যাপক শিবলীর নাম প্রস্তাব শেষ হলে উপস্থিত সিনেটররা বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। এরপর প্রথা অনুযায়ী অপর সিনেটর জনাব এস. এম. বাহালুল মজনুন চুন্নু প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। তিনটি নামসহ প্রস্তাবটি তখন অনুমোদনের জন্য সভাপতির নিকট পাঠানো হলে, তিনি প্রস্তাবটি নিরীক্ষার জন্য দু’জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন। এ সময় আবারও অধ্যাপক আজিজ ফ্লোর চাইলে সভাপতি মহোদয় নিরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁকে অপেক্ষা করতে বলেন।

নিরীক্ষা শেষে বিশ্ববিদ্যায়ের রেজিস্ট্রার তিনটি নাম সভাপতির সামনে উপস্থাপন করেন। সভাপতি মহোদয় তখন সিনেটরদের উদ্দেশ্যে নামগুলো পুনরায় পড়ে শোনান এবং সিনেটকে অবহিত করেন যে এই একটি প্যানেলই উত্থাপিত হয়েছে। তিনি সিনেটরদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন যে আর কোন প্রার্থীর নাম বা অন্য কোন প্যানেল আছে কি না। এসময় সিনেট ছিল নিশ্চুপ। খানিক বিরতিতে তিনি আবারো ঐ একই প্রশ্ন করেন। কিছুটা বিরতি দিয়ে তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রশ্নটি করেন। এই তিনবারই সিনেট ছিল নিশ্চুপ। অধ্যাপক ড. আজিজ এসময় কেন তার প্রস্তাব বা বক্তব্য উত্থাপন করলেন না তা আমার বোধগম্য নয়। শুনেছি (নিশ্চিত নই), উনি কোন এক সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছনে উনি ঐ প্রস্তাবের বিরোধিতা করার জন্য ফ্লোর চান নি। নতুন কোন নাম প্রস্তাবিত না হওয়ায় সভাপতি মহোদয় ঘোষণা দেন যে প্রস্তাবটি গৃহীত হল। যেহেতু সিনেটের এই বিশেষ অধিবেশনে একটি মাত্র এজেন্ডা ছিল, তাই প্যানেল চুড়ান্ত হবার পর তিনি অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

এই পুরো প্রক্রিয়ায় কোথায় আইনের ব্যাত্যয় ঘটেছে তা আমি বুঝতে পারিনি বা আমি যাদের সাথে আলোচনা করেছি তারাও কেও বলতে পারেননি। তবে হ্যাঁ, কথা উঠেছে প্যানেলে নামের ক্রম নিয়ে। খেয়াল করুন, সিনেটে যে ক্রমে নামগুলো লিখিতভাবে প্রস্তাবিত হয়েছে, সেই ক্রমেই তা গৃহীত ও অনুমোদিত হয়েছে। জানিয়ে রাখি, আগের দিন ৩০শে জুলাই নীল দলের নির্বাচিত সিনেট সদস্যরা (সর্বমোট ৫৩ জন) ভোটের মাধ্যমে এই তিনটি নাম নির্বাচন করেন।

নামগুলো কি ক্রমে সিনেটে উপস্থাপিত হবে তা তাঁরাই জানবেন, সিনেটের বাকী ৪৫ জন সদস্য বা সিনেট সভাপতির তা জানার কথা নয়। ফলে, সিনেটে যে ক্রমে নামগুলো উপস্থাপিত হয়েছে সিনেট সভাপতি সেভাবেই তা গ্রহণ করেছেন এবং সিনেটের সামনে অনুমোদনের জন্য পেশ করেছেন। নামগুলো প্রস্তাব হবার পর ওই ৫৩ সিনেট সদস্য অধিবেশন চলাকালীন সময়ে কেন এই ক্রমকে চ্যালেঞ্জ করেননি তার সদুত্তর আমি পাইনি। যদি করতেন, তাহলে হয়তো আজকের এই ধুম্রজাল সৃষ্টি হতো না। (ফেসবুক থেকে সংগ্রহ)

লেখক: ড. আবু তোফায়েল মো.সামসুজ্জোহা, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।