বাসে গায়ে গা লাগলেই মারমুখী হয়ে উঠি, শেষটা কী হয়?

আনিসুর রহমান

আজ সকালে অফিসের উদ্দেশে মহাখালী থেকে বাসে চড়ে যাচ্ছি মতিঝিল। ১৭-১৮ বছরের কিউট একটা ছেলে ভাড়া কাটছে। ভাড়া ২০ টাকা। কিন্তু আমি মানি ব্যাগ থেকে ১০ টাকার কচকচে একটা নতুন নোট বের করে তার চোখে চোখ রেখে কনফিডেন্টের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে বললাম, এই নাও, ছাত্রভাড়া। সে আমার দিকে তাকিয়ে খানিক থমকে হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে বললো, ‘এই এই পর্যন্ত ৬ জনে ছাত্রভাড়া দিল, আপনেরে লইয়া ৭ জন।’

ছাত্রভাড়া দিলে কেউই খুশি হয় না। সবার মুখখানাই ঈষৎ কালো বর্ণ ধারণ করে, তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না। বললাম, ছাত্রভাড়া দেওয়ায় কি মন খারাপ করলা? সে বেজার মুখেই বলছে, না ভাই, মন খারাপের কী আছে! দুজনের কথোপকথন খেয়াল করছে পাশের যাত্রীরা। আমি তাকে আরো ১০ টাকা বের করে দিয়ে বললাম, নাও, তোমাকে পুরা ভাড়াই দিলাম। সে এবার মুখভর্তি হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিলো।

বললাম, আসলে ছাত্রভাড়া কেউই পছন্দ করে না! ভাড়া কম পেয়ে তোমারও হাসিখুশি মুখটা কালো হয়ে গেছে। আরো বললাম, তোমার সাথে জীবনে একবারই দেখা, হয়তো আর কখনোই দেখা হবে না। আমি তোমার মনটা খারাপ করে দেবো এটা কি হয়? তুমি এখন আমার দিকে তাকিয়ে যে প্রাণখোলা একটা হাসি দিয়েছ এর মূল্য আমার কাছে কোটি টাকার বেশি। সে এবার আরো জোরে হাসলো। সে ভাড়া কেটে যাচ্ছে, বাস ততক্ষণে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের কাছাকাছি।

আমি খেয়াল করলাম, হাসি থামলেও তার চেহারায় হাসির ঝিলিকটা ছিল বেশ সময় ধরে। মনে পড়ে গেল গোবিন্দ হালদারের বিখ্যাত সেই গান, 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।' আমার পাশের সিটে বসা লোকটি আমার কথাবার্তা শুনে হাসছে, আমি উনাকে বললাম, আমি তো ছাত্র না। ছেলেটিকে দেখে ভালো লেগেছে, তার সাথে একটু মজা করলাম, উনিও এবার বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে- কী বলেন, আপনি ছাত্র না!! ও আচ্ছা! হা হা হা। আপনি ভালোই মজা করতে পারেন।

বললাম, হ্যাঁ আমি মজা করি। নিজে হাসি, আরেকজনকে হাসাতে পছন্দ করি। দেখলেন না! ছেলেটা ২০ টাকা ভাড়া পেয়ে কী সুন্দর করে ভুবন ভোলানো একটা হাসি দিয়েছে! অথচ, আমি তো তাকে এক টাকাও বাড়তি দেইনি, ন্যায্য ভাড়াই দিয়েছি। আসলে কারো মুখে হাসি ফোটাতে সবসময় যে টাকা লাগে তা নয়, একটু মিষ্টি কথা, একটু সুন্দর ব্যবহার, মুচকি হাসি দিয়ে অনেকের মন ভালো রাখা যায়, মুখে হাসি ফোটানো যায়।

সাধারণত পথে-ঘাটে, যানজট, গরম ও অফিসে সময় মতো পৌঁছার তাড়াসহ নানা কারণে মানুষের মেজাজ থাকে চড়া। কারো সাথে একটু মতের অমিল হলে কিংবা গায়ের সঙ্গে গা লাগলে মারমুখী হয়ে ওঠেন অনেকেই, ভাষা হয়ে ওঠে কর্কশ। এতে কোনো অর্বাচীন যদি আপনাকে কোনো কারণে বা অকারণে একটা গালি দিয়ে ফেলে এতে আপনার মেজাজ নষ্ট হবে, মুড নষ্ট হবে। সব ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে আমাদের উচিত নিজেকে এমনভাবে প্রাণবন্ত রাখা যেন এর উচ্ছলতা আশপাশেও ছড়িয়ে যায়। ফলে খামোখা ঝগড়া-ঝাটি তো দূরের কথা, প্রচণ্ড মেজাজ খারাপের পরিবেশেও পরস্পরের প্রতি মন ভালো থাকবে সবার, ভিড়ের মাঝে গায়ের সঙ্গে গা লাগলেও আপনাকে কেউ চোখ রাঙানি দেবে না, বরং পরিচিতজনের মতোই খুব স্বাভাবিক আচরণ করবে। এটা প্রমাণিত।

আমি যেখানে যাই, যেখানে থাকি, পরিবেশটা চাই অনুকূলে রাখতে, প্রাণবন্ত রাখতে। সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে চাই। জীবন সুন্দর, মানুষ সুন্দর, সুন্দর এই পৃথিবী। ভালো থাকুক প্রতিটি মানুষ। সবার জন্য শুভ কামনা।

সকাল ১০টা, ১৯ জুন, ২০১৯। (লেখকের ফেসবুক থেকে )