যে মাঠ জাকিকে বাঁচতে শিখিয়েছে, সেই মাঠেই শেষ বিদায়

ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ মাহবুব আলী জাকির জানাজা
ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ মাহবুব আলী জাকির জানাজা © সংগৃহীত

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) জয় দিয়েই শুভসূচনা করেছে ঢাকা ক্যাপিটালস। রাজশাহী ওয়ারিয়র্সকে হারিয়ে মাঠ ছাড়লেও সেই জয়ের আনন্দ গভীর শোক ও বেদনায় ছাপিয়ে গেছে। খেলোয়াড়দের চোখে মুখে ছিল না কোনো উচ্ছ্বাস, বরং প্রিয় মানুষকে হারানোর ভারাক্রান্ত অনুভূতিই স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে।

শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) দুই দলের ম্যাচ শুরুর আগেই ঘটে হৃদয়বিদারক এই ঘটনা। ম্যাচের আগে মাঠে নামার প্রস্তুতি হিসেবে যখন ঢাকার ক্রিকেটাররা ওয়ার্ম-আপে ব্যস্ত, তখন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন সহকারী কোচ মাহবুব আলী জাকি। হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে মুহূর্তের মধ্যেই মাঠে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসেন সতীর্থ, কোচ, খেলোয়াড় ও মেডিকেল টিম। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত তাকে হাসপাতালেও নেওয়া হয়।

তবে চিকিৎসকরা জানান, মাঠ থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই হার্ট অ্যাটাকে প্রাণ হারান দেশবরেণ্য এই কোচ। যে মাঠে দাঁড়িয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শিষ্যদের পাশে ছিলেন তিনি, সেই মাঠ থেকেই তাকে অশ্রুসজল বিদায় জানান সহকর্মী ও শিষ্যরা। মাঠের মানুষ, মাঠেই শেষ অধ্যায় লিখলেন তিনি। যে কারণে ঢাকা ক্যাপিটালসের এই জয়ের দিনটি স্মরণীয় হয়ে রইল আনন্দের চেয়ে অনেক বেশি শোকের ভার নিয়েই।

৫ উইকেটে রাজশাহীকে হারানোর পর সেই জয় প্রয়াত কোচ মাহবুব জাকিকে উৎসর্গ করেছে রাজধানীর দলটি। ম্যাচ শেষে গভীর শোক প্রকাশ করেন ঢাকার অধিনায়ক মোহাম্মদ মিঠুন। তিনি জানান, এই জয় মাঠের ভেতর-বাইরে সবার জন্যই ভীষণ আবেগঘন।

ম্যাচ শেষে দলটির অধিনায়ক মিঠুন বলেন, ‘আমাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের খবর। জাকি স্যার মারা গেছেন। তার পরিবারের প্রতি আমাদের সমবেদনা ও দোয়া রইল। তবে একটি ভালো জয়। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটি ক্ষতি। তিনি আমাদের কাছে অনেকটা বাবার মতো ছিলেন। আমি মনে করি, এটি আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতি। আমরা যখনই কোনো ম্যাচ খেলি, জেতার জন্যই খেলি। এই জয় আমি জাকি স্যারকে উৎসর্গ করছি। ইনশা আল্লাহ, আল্লাহ তাঁকে জান্নাত দান করবেন।’

এদিকে সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠিত হয় জাকির প্রথম জানাজার নামাজ। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলসহ বিসিবির শীর্ষ কর্মকর্তারা। সেখানে আরও ছিলেন জাকির সহকর্মী কোচরা, তার প্রিয় ক্রিকেটাররা এবং ক্রীড়া সাংবাদিকরাও। পুরো স্টেডিয়ামজুড়েই ছিল শোকাবহ, নীরব পরিবেশ।

শেষবারের মতো প্রিয় কোচকে দেখতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন জাতীয় দলের পেসার শরিফুল ইসলাম। আবেগ সামলাতে পারেননি মুশফিকুর রহিমও। কোচ তালহা জুবায়ের, হান্নান সরকার, খালেদ মাহমুদ সুজন ও রাজিন সালেহরা বেদনাভরা চোখে জাকির মরদেহের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অধিনায়ক মিঠুনও কষ্ট চেপে ধরে নিজের আবেগ সংবরণ করার চেষ্টা করেন।

জানাজার আগে বিসিবি সভাপতি বুলবুল প্রয়াত কোচ জাকির আত্মার মাগফেরাত কামনায় সবার কাছে প্রাণ খুলে দোয়ার আহ্বান জানান। 

২০০৮ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের হাই-পারফরম্যান্স কোচ হিসেবে কাজ শুরু করেন জাকি। দীর্ঘদিন দেশের পেস বোলিং কাঠামো গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তার। ২০১৬ সালে তাসকিন আহমেদের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে যখন বিতর্ক ও প্রশ্ন উঠেছিল, তখন সেই অ্যাকশন সংশোধনের পেছনে জাকির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাশরাফি বিন মুর্তজা, তাসকিন আহমেদসহ জাতীয় দলের বহু পেসারের মেন্টর হিসেবে নীরবে-নিভৃতে কাজ করে গেছেন সাবেক এই পেসার।

২০২০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যখন ইতিহাস গড়ে শিরোপা উল্লাসে মেতেছিল, তখন সেই দলের কোচিং প্যানেলের অন্যতম প্রধান সদস্য ছিলেন মাহবুব জাকি। পেস বোলিং কোচ হিসেবে তরুণদের গড়ে তোলায় তার অবদান অনস্বীকার্য। জাতীয় দল থেকে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, সব স্তরেই তার ছাপ স্পষ্ট।

আর ক্রিকেটের পুণ্যভূমি সিলেটেই দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য ক্রিকেট জীবনের বিয়োগান্ত সমাপ্তি ঘটল। যে মাঠ জাকিকে বাঁচতে শিখিয়েছে, সেই মাঠেই তার শেষ বিদায় হলো!