শিক্ষায় এডিপি বরাদ্দ আরও কমল
- ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮:৩৫
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় শিক্ষা খাতে থাকা বরাদ্দ আরও কমিয়েছে সরকার। ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা থেকে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) শিক্ষা খাতে বরাদ্দ প্রায় ১০ হাজার কোটি কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা, যা এডিপির তুলনায় ৩৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ১৮৯টি সদস্য দেশের মধ্যে যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের বিবেচনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। দেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশেরও কম বরাদ্দ থাকে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে। এরই মধ্যে গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল এই খাতে।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এডিপির আওতায় শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। আরএডিপিতে এখান থেকে ৯ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে।
সংশোধিত এডিপির খসড়া প্রস্তাবনায় দেখা গেছে, সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ব্যয় ৪৭ শতাংশ বা ৫ হাজার ৬০২ কোটি টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা, যা মূল এডিপিতে ছিল ১১ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। অবশ্য বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। মূল বরাদ্দ থেকে ২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা যোগ করে সংশোদিত এডিপিতে এর আকার দাঁড়াচ্ছে ৮ হাজার ৫৪ কোটি টাকা, যা ৩৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। একইভাবে কারিগরি ও মাদ্রাসাশিক্ষা বিভাগে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে ১ দশমিক ৭০ শতাংশ। এখানে বরাদ্দ বাড়ছে ৫৩ কোটি টাকা। ফলে কারিগরি ও মাদ্রাসাশিক্ষা বিভাগের মোট আকার দাঁড়াচ্ছে ৩ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা, মূল এডিপিতে যা ছিল ৩ হাজার ৮০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এডিপিতে বরাদ্দ করা ব্যয়-সক্ষমতার ভিত্তিতে সংশোধিত এডিপির বরাদ্দ বিবেচনা করা হয়। গত ৫ মাসে শিক্ষার মতো আরও কয়েকটি খাতে এডিপি বাস্তবায়ন মোটেও সন্তোষজনক নয়। সে কারণে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমানো হচ্ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) হালনাগাদ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন বলছে, জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গত ৫ মাসে এর মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের হার মাত্র ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ১১ হাজার ৯১৭ কোটি টাকার বরাদ্দের মধ্যে ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে ১ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৯০ শতাংশই এখনও বাস্তবায়নের বাইরে রয়ে গেছে।
সরকারের খাতায় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ বরাদ্দের ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ বরাদ্দ রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য। এডিপিতে এই ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বরাদ্দ ৭৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বাস্তবায়ন হচ্ছে ৫৬টি প্রকল্প। অন্যদিকে শিক্ষা খাতের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম। গত ৫ মাসে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের মাত্র ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। ৮০৭ কোটি টাকা। বরাদ্দ রয়েছে ৫ হাজার ৮০৩ কোট টাকা। ৬টি প্রকল্প বর্তমানে এই বিভাগের অধীনে বাস্তবায়ন হচ্ছে। সর্বোচ্চ বরাদ্দের ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে এই বিভাগের বরাদ্দ ১৩তম অবস্থানে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চাহিদা ও বিগত ৫ মাসের বাস্তবায়ন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আরএডিপি বরাদ্দের খসড়া তৈরি করে থাকে পরিকল্পনা কমিশন। পরিকল্পনা কমিশনের এই খসড়া প্রস্তাবের ওপর পর্যালোচনা শেষে আরএডিপি অনুমোদন দিয়ে থাকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। আগামী মাসের মাঝামাঝি নাগাদ এনইসি বৈঠক হতে পারে বলে কমিশন সূত্র জানিয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করা উন্নয়ন সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, শিক্ষা খাতে আমাদের বরাদ্দ এমনিতেই লজ্জাজনক কম। এমনকি অর্থনীতির আকারের বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও বাংলাদেশের মত এত কম বরাদ্দ আর কোনো দেশের নেই।
তিনি বলেন, এই কম বরাদ্দের পরও মাঝপথে এসে তা আবারও ছেঁটে ফেলার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটার বড় কারণ হচ্ছে, আমাদের নীতি প্রণেতারা শিক্ষায় বিনিয়োগকে সাধারণ নিছক একটা বরাদ্দই মনে করেন। এটা যে মানবসম্পদ উন্নয়নের বিরাট হাতিয়ার, সেটা শুধু কর্তৃত্ববাদী সরকারই নয়, প্রকৃতপক্ষে কোনো সরকারই আমলে নেয়নি। বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকারের কাছে আমরা এ বিষয়ে বড় একটা আশা করেছিলাম। কিন্তু তারাও সেই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকতে পারল না। শিক্ষা ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বিনিয়োগে অনীহার কারণে আমাদের শিক্ষার মান অত্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে।
তার মতে, সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। শিক্ষায় ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে। সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট ও মানসম্পন্ন বিনিয়োগ না হওয়ায় শিক্ষা খাতে পারিবারিক বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষা ব্যয় ৭০ শতাংশ ব্যক্তি খাত থেকেই করতে হচ্ছে। এত বড় ব্যয় তো সবার পক্ষে করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে কম আয়ের মানুষের পক্ষে সেটা তো অসম্ভব ব্যাপার। অথচ গত কয়েক দশকের শিক্ষার চাহিদা তৈরি হয়েছে। সব মা-বাবাই চান সন্তানকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে। এই সুযোগটা কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছেঁটে ফেলার একটা বড় কারণ হয়তো শিক্ষা খাতের প্রকল্পগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন সম্ভব না হওয়া। আমি বলব, এটা হয়তো সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ার কারণেই হয়ে থাকতে পারে।